বড় ভাই-ছোট ভায়ের লড়াই ঝিনাইদহ-৪ আসনে
ঝিনাইদহ-৪ আসনে আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন পেতে আবারো শুরু হয়েছে বড়ভাই-ছোট ভাই এর লড়াই। দলটির কালীগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি সাবেক সাংসদ আব্দুল মান্নান আর সাধারণ সম্পাদক বর্তমান সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনারের মধ্যে চলছে এই লড়াই। রাজনীতিতে তারা এখন চরম প্রতিদ্বন্দি হলেও এক সময় ছিলেন খুবই আপনজন। অনেকে তাদেরকে বড়ভাই-ছোটভাই আবার অনেকে গুরু-শিষ্য হিসেবে চেনেন। দলীয় কর্মীরা অপেক্ষায় আছেন মনোনয়ন দৌড়ে এই দুই নেতার কে হারে আর কে জিতে।
প্রসঙ্গত ঝিনাইদহ-০৪ আসনটি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার চারটি ইউনিয়ন ও কালীগঞ্জ উপজেলা ১১ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এখানে আওয়ামীলীগ থেকে দু’টি নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হয়ে তৃতীয় বারে সাংসদ নির্বাচিত হন উপজেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মান্নান। তিনি এবারও প্রার্থী হবার ইচ্ছা দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। আশা করছেন তিনিই মনোনয়ন পাবেন। আর আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে আব্দুল মান্নানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে যান দলের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল আজিম আনার। তিনি এখনও সাংসদ এবং একাদশ নির্বাচনে অংশ নিতে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তিনিও আশা করছেন মনোনয়ন পাবেন।
এছাড়াও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠান্ডু, বিশিষ্ঠ শিল্পপতি ও বাংলাদেশ বাস্তহারালীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন বাবু, কালীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান বিজু, উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান মতি ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদ সমশের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। তারাও চেষ্টা করে যাচ্ছেন দলীয় মনোনয়নের।
আওয়ামীলীগের মাঠ পর্যায়ের নেতারা জানান, মূলত এই আসনে মনোনয়ন নিয়ে আব্দুল মান্নান ও আনোয়ারুল আজিম আনারের মধ্যে জোর লড়াই চলছে। তারা দু’জনই নিজেদের অবস্থান প্রমান করতে স্থানিয় ভাবে নানা সময়ে মহড়া দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় কর্মসুচি গুলোও তারা পৃথক ভাবে পালন করে থাকে। যা দলটিকে রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অনেকে সরকারি দলের কর্মী হয়েও হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন।
মাঠ পর্যায়ের এক নেতা নাম প্রকাশ না করে জানান, ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের সময়ও আব্দুল মান্নান বিএনপি’র প্রার্থীর পক্ষে ছিলেন। ১৯৯২ সালে কালীগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনেও আব্দুল মান্নান বিএনপি’র সমর্থন নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আর এ সময় আনোয়ারুল আজিম আনার হন কমিশনার। পৌরসভা নির্বাচনের কিছুদিন পর আব্দুল মান্নান বিএনপি ত্যাগ করে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। আর এই গোটা সময় আনোয়ারুল আজিম আনার ছিলেন আব্দুল মান্নানের সঙ্গে।
২০০৬ সালে আওয়ামীলীগের উপজেলা শাখার সম্মেলনেও তারা দু’জন ছিলেন এক সঙ্গে। সে সময় আওয়ামীলীগের বিবাদ ছিল দলটির উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠান্ডু’র সঙ্গে আব্দুল মান্নানের। যে বিবাদের কারনে প্রাণ দিতে হয়েছে ছাত্রলীগের সেই সময়ের উপজেলা শাখার সভাপতি খন্দকার রেজাউল করিম রেজা, যুবলীগ নেতা আব্দুল মান্নান, বারোবাজার ইউনিয়ন যুবলীগের সহ-সভাপতি শহিদুল ইসলাম ও ছাত্রলীগ উপজেলা শাখার যুগ্ন-সম্পাদক ডাবলুকে। এরা সকলেই দলের অভ্যান্তরিন কোন্দলে খুন হন। আব্দুল মান্নান আর ঠান্ডুর মধ্যে বিরোধ সে সময় তুঙ্গে পৌছায়।
এদিকে বিরোধপূর্ণ এই অবস্থায় ২০০৬ সালে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলনে সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠান্ডু ও সাবেক সম্পাদক ইসরাইল হোসেনকে পরাজিত হয়ে আব্দুল মান্নান সভাপতি ও আনোয়ারুল আজিম আনার সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনের পর দলের মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীরা আশা করেছিলেন দলটির দীর্ঘ দিনের বিরোধ কেটে যাবে। আব্দুল মান্নান আর আনোয়ারুল আজিম আনার এক সঙ্গে দলীয় কাজ করবে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীদের সেই আশা পুরণ হয়নি, নেতৃত্বে এসে তারা বড়ভাই-ছোটভাই নিজেরাই বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।
স্থানিয়রা জানান, মূলত আব্দুল মান্নান ও আনোয়ারুল আজিম আনার সভাপতি আর সম্পাদক নির্বাচিত হবার পর কমিটির বাকি পদগুলো পুরনের সময় তাদের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। আর এই বিরোধ ধরেই ২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনে আব্দুল মান্নানের পাশাপাশি আনোয়ারুল আজিম আনারও মনোনয়ন প্রত্যাশী হন। ফলে দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীরাও আবারো বিভক্ত হয়ে যায়। শুরু হয পাল্টাপাল্টি মিছিল সমাবেশ। শেষ পর্যন্ত আনোয়ারুল আজিমকে পেছনে ফেলে আব্দুল মান্নানই দলীয় মনোনয়ন পান। আর আনার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হন। পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আব্দুল মান্নানকে পেছনে ফেলে দলীয় মনোনয়ন পান আনোয়ারুল আজিম আনার। তিনি বর্তমান সাংসদ সদস্য হিসেবে রয়েছেন, আগামী নির্বোচনেও মনোনয়ন পাওয়ার লড়াই করে যাচ্ছেন।
দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী আব্দুল মান্নান জানান, কারো সঙ্গে তার কোনো বিরোধ নেই। দল করেন, একবার সাংসদ হয়েছেন। সাংসদ হয়ে এলাকার কাজ করেছেন। ফলে আবারো এলাকার মানুষের জন্য কাজ করতে চান। তিনি এবার দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদি বরে জানিয়েছেন। আনোয়ারুল আজিম আনার জানান, বড় দলে মতবিরোধ থাকতে পারে। তিনি বর্তমানে সংসদ সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তার সময়ে এলাকার ব্যপক উন্নয়ন হয়েছে। যে কারনে দল তাকে আবারো মনোনয়ন দেবেন বলে আশা করছেন।
আর মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্যদের দাবি বর্তমান ও সাবেক সাংসদের মধ্যে যে বিরোধ রয়েছে তাতে একজন মনোনয়ন পেলে অন্যজনের সমর্থকরা ভোটের মাঠ থেকে সরে দাড়াতে পারেন। কিন্তু তৃতীয়পক্ষের কেউ মনোনয়ন পেলে সবপক্ষকে একত্রিত করে আসনটি ধরে রাখা সম্ভব হবে।