আবুজর গিফারি (রা.) যেভাবে ইসলামের ছায়াতলে এলেন
জুনদুব ইবনে জুনাদা (রা.)। আবুজর গিফারি নামেই তিনি অধিক পরিচিত। সিরিয়ার পথে ‘অদ্দান’ উপাত্যকায় বসবাসকারী ‘গিফার’ গোত্রে তার জন্ম। মানুষের মালামাল লুটতরাজ করা ছিল এ গোত্রের লোকদের পেশা। জাহেফল যুগে আবুজর গিফারিও জড়িয়ে পড়েছিলেন রাহাজানি কর্মকা-ে। কিন্তু মক্কার জমিনে হেদায়েতের রবি, মানবতার নবীর আর্বিভাব হলে আল্লাহ পাক তাকে প্রথম পর্বেই ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য দান করেন। চতুর্থ বা পঞ্চম মুসলমান হিসেবে ইতিহাসে তার নাম পাওয়া যায়।
তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বড় আশ্চর্যজনক। একদিন তিনি সংবাদ পেলেন, মক্কায় এক নতুন নবীর আবির্ভাব হয়েছে। তিনি তার ভাই আনিসকে মক্কায় পাঠালেন সে নবী সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য। আনিস মক্কায় এসে নবীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার মুখ থেকে কিছু কথা শ্রবণ করে নিজ গোত্রে ফিরে যান। খবর পেয়ে আবুজর (রা.) ছুটে আসেন এবং অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে নতুন নবী সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করেন। আনিস বললেন, ‘কসম আল্লাহর, আমি লোকটিকে দেখলাম, মানুষকে মহৎ চরিত্রের দিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। আর এমন সব কথা বলেন, যা আমার কাছে কাব্য বলে মনে হলো না।’ আবুজর বললেন, মানুষ তার সম্পর্কে কী বলাবলি করে? তিনি বললেন, কেউ বলে জাদুকর, কেউ বলে গণক আবার কেউ কবিও বলে।’ একথা আবুজরের তৃষ্ণা মেটাতে পারল না। তিনি বললেন, তুমি আমার আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারলে না। তুমি কি আমার পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবে? যাতে আমি মক্কায় গিয়ে স্বচক্ষেই তার অবস্থা দেখে আসতে পারি? আনিস বললেন, ‘নিশ্চয় পারব। তবে আপনি মক্কাবাসীর সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন।’
পরদিন প্রত্যুষে আবুজর (রা.) চললেন মক্কার উদ্দেশে। সঙ্গে নিলেন কিছু পাথেয় ও পানির মশক। মক্কায় পৌঁছে তিনি কারও কাছে নতুন নবী সম্পর্কে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করা সমীচীন মনে করলেন না। কারণ, তার জানা নেই জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিটি নবীর বন্ধু না শত্রু। ভয় ও শঙ্কায় দিনটি কেটে গেল। রাত নেমে এলে তিনি মসজিদুল হারামের এককোণে শুয়ে পড়লেন। তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। আলী (রা.) যাচ্ছিলেন সে পথ দিয়ে। লোকটিকে দেখেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এ একজন মুসাফির। তিনি তাকে মেহমান বানিয়ে নিজ গৃহে নিয়ে গেলেন। পরদিন সকালবেলা পানির মশক ও খাবারের পুঁটলিটি হাতে নিয়ে তিনি বের হয়ে এলেন। দুজনের কেউ অপরজনকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। দ্বিতীয় দিনটিও কেটে গেল নবীজির সাক্ষাৎবিহীন। আজও তিনি মসজিদুল হারামে শুয়ে পড়লেন। আলী দেখলেন, লোকটি আজও তার গন্তব্যস্থল চিনতে পারেনি। তিনি তাকে সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এদিনও কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। একইভাবে তৃতীয় দিনটিও চলে গেল।
সন্ধ্যায় আলী দেখলেন, লোকটি আজও মসজিদে শুয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘বলুন তো, আপনি কোন উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছেন?’ আবুজর গিফারি বললেন, ‘আপনি যদি অঙ্গীকার করেন যে, আমাকে কাক্সিক্ষত ব্যক্তির সন্ধান দেবেন, তাহলে আমি বলতে পারি।’ আলী (রা.) তাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন। আবুজর বললেন, আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। নতুন নবীর দর্শনলাভ এবং তার মুখনিঃসৃত কথা শোনা আমার উদ্দেশ্য।
আলীর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠল। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, অবশ্যই তিনি সত্য নবী। নবীজি সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু শোনালেন। এরপর বললেন, ‘সকালে আমি যেখানে যাই, আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন। যদি আমি আশঙ্কাজনক কিছু লক্ষ্য করি তাহলে প্রস্রাবের ভান করে দাঁড়িয়ে যাব। আপনি চলতে থাকবেন। যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে, আপনি আমার সঙ্গে যাচ্ছেন। এভাবে আমি যেখানে প্রবেশ করি আপনিও সেখানে প্রবেশ করবেন।’ প্রিয়নবীর দর্শনলাভ ও তার ওপর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ শ্রবণের প্রবল আগ্রহ ও উৎকণ্ঠায় আবুজর (রা.) সারাটি রাত বিছানায় স্থির হতে পারলেন না।
পরদিন সকালে তাকে নিয়ে আলী (রা.) চললেন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বাড়ির দিকে। আবুজর তার পেছনে পেছনে। পথের কোনো কিছুর প্রতি তার ভ্রুক্ষেপ নেই। এভাবে তারা পৌঁছলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে। আবুজর (রা.) সালাম করলেনÑ ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ।’ রাসুল (সা.) জবাব দিলেনÑ ‘ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ।’ এভাবে আবুজর গিফারি (রা.) সর্বপ্রথম ইসলামী কায়দায় রাসুলুল্লাহকে সালাম পেশ করার গৌরব অর্জন করেন। (উসদুল গাবাহ : ১/১৯০)। পরবর্তী সময়ে সালাম বিনিময়ের এ পদ্ধতিই গৃহীত হয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আবুজরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং পবিত্র কোরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শোনালেন। তিনি সেখানেই কালেমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে যান। নবীজি (সা.) বললেন, এখন তুমি তোমার কবিলায় ফিরে যাও। কারণ, এখানকার পরিবশ নিরাপদ নয়। কিন্তু তিনি বললেন, সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, আমি কোরাইশদের সামনে আমার ইসলামের কথা ঘোষণা করব। অতঃপর তিনি মসজিদে হারামের সামনে গেলেন। সেখানে কোরাইশরা বসে গল্প-গুজব করছিল। তিনি তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যতদূর সম্ভব উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল।’
এ কথাগুলো তাদের কানে পৌঁছা মাত্র একযোগে তারা লাফিয়ে উঠল। তাকে বেদম প্রহার করতে শুরু করল। নবীজির চাচা আব্বাস (রা.) তাকে দেখে চিনে ফেললেন। তাদের হাত থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে তিনি আবুজরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। এরপর তাদের উদ্দেশে বললেন, গিফার গোত্রের এই লোককে হত্যা করলে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য। তোমরা জান না তোমাদের বাণিজ্য কাফেলা গমনাগমনের পথ গিফার গোত্রের পাশ দিয়ে। উল্লেখ্য, বাইরের জগতের সঙ্গে মক্কার সংযুক্তি ঘটিয়েছে যে ‘অদ্দান’ উপাত্যকাটি, সেখানেই ছিল ‘গিফার’ গোত্রের বসতি। কোরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা সেখান দিয়েই সিরিয়া যাতায়াত করত। আব্বাসের কথায় তারা আবুজরকে ছেড়ে দিল।
তিনি রাসুলের কাছে ফিরে গেলেন। তার অবস্থা দেখে নবীজি বললেন, ‘আমি তোমাকে ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলাম না? তিনি উত্তর করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! নিজের মধ্যে প্রবল ইচ্ছা অনুভব করেছিলাম। সে ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি মাত্র।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমার গোত্রের কাছে ফিরে যাও। যা দেখে গেলে এবং যা কিছু শুনে গেলে তাদের অবহিত করবে এবং তাদের আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাবে। হতে পারে আল্লাহ তোমার দ্বারা তাদের উপকৃত করবেন এবং তোমাকে এর উত্তম বিনিময় দান করবেন। যখন জানবে আমি প্রকাশ্যে দাওয়া দিচ্ছি তখন আমার কাছে চলে আসবে।’
তিনি নিজ গোত্রের কাছে ফিরে গেলেন। তার ভাই আনিস এসে জিজ্ঞেস করল, কী করলেন? আবুজর (রা.) বললেন, ইসলাম কবুল করে বিশ্বাসী হয়েছি। আল্লাহ পাক তার অন্তরকেও ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। তিনিও ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলেন। তারপর তারা সর্বপ্রথম তাদের গর্ভধারিণী মাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তিনি বললেন, তোমাদের দুই ভাইয়ের দ্বীন গ্রহণের প্রতি আমার কোনো অনীহা নেই। তিনিও ইসলাম গ্রহণ করার ঘোষণা দিলেন। সেদিন থেকে এই বিশ্বাসী পরিবার গিফার গোত্রের লোকদের কাছে নিরলসভাবে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে থাকেন। তাদের আপ্রাণ চেষ্টায় এ গোত্রের বিপুল সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করে। ইসলামের বদৌলতে আল্লাহ পাক তাদের পথের রাহজান থেকে রাহবার বানিয়ে দিয়েছেন।
এই গিফার গোত্র সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘গিফার গোত্রÑ আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন আর আসলাম গোত্র আল্লাহ তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দিয়েছেন।’ (উসদুল গাবাহ : ১/৩২৭)। দুনিয়াবিমুখ এই সাহাবি ৩২ হিজরিতে ‘রাবজা’ নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। সারাটি জীবন সত্যের ওপর অবিচল ছিলেন এবং সত্যকথা বলতে তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আসমানের নিচে এবং জমিনের ওপরে আবুজর সর্বাধিক সত্যবাদি ব্যক্তি।’ (আল ইসাবা : ৭/১২৯)।