মেক্সিকোর জেলে বন্দি ৩৯১ বাংলাদেশির ভাগ্যে কী ঘটবে?
ঝিনাইদহের চোখঃ
>> দুই মন্ত্রণালয়ের চিঠি চালাচলি
>> মন্তব্য করতে রাজি হননি দুই মন্ত্রণালয়ের কেউ
>> প্রত্যেকেই মানব পাচারের শিকার
বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে মেক্সিকোতে আটক হচ্ছেন বাংলাদেশিরা। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দেশটির জেলে বন্দিদের মধ্যে ৩৯১ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনতে গত বছরের মাঝামাঝি সময় মেক্সিকো থেকে বাংলাদেশকে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু এখনও এসব বাংলাদেশির নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজ শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২০ জুন ৩৯১ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় মেক্সিকো। এরপর তাদের নাগরিকত্ব যাচাই করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অপরদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পররাষ্ট্রেও একটি চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজে একজন প্রতিনিধি চায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরে সেই চিঠিটি ফেরত চেয়ে আবারও চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বাতিল করার জন্য বলা হয়।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, এটি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিষয়। এদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ে দ্রুত একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো উচিত। কারণ, যারা বর্তমানে আটক রয়েছেন তারা প্রত্যেকেই মানব পাচারের শিকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন লিবিয়া থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত নিয়ে এসেছে তখন কোনও ঝামেলা হয়নি। পুরো কাজটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একা করে। সেখানে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে (আইওএম) সঙ্গে নেয়া হয়েছিল। মেক্সিকোর দায়িত্বটিতে আইওএমকে সংশ্লিষ্ট পক্ষ করার চিন্তা করা হয়েছিল। তাহলে কাউকে যেতে হবে না, আইওএমই সবাইকে নিয়ে আসবে। তবে সেটিও থামিয়ে দেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের আগে কয়েকটি দেশ হয়ে মেক্সিকোয় আসেন বাংলাদেশিরা। কখনও কখনও ১০ থেকে ১২টি দেশ পার হওয়ার ঘটনা ঘটে। মানবপাচারের রুট হিসেবে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে দুবাই, ইস্তান্বুল অথবা তেহরান যান বাংলাদেশিরা। পরবর্তীতে সেখান থেকে ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া অথবা স্প্যানিশ গায়ানা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা।
আবার অনেক সময় ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, গায়ানা ও বলিভিয়া থেকে দুর্গম পথে যাত্রা করে কলম্বিয়া, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, এলসালভাদর, গুয়াতেমালা হয়ে মেক্সিকো পৌঁছিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীদের।
পরবর্তীতে মেক্সিকো থেকে সুযোগ বুঝে সীমানা অতিক্রম করে স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এ জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে দায়িত্বে থাকেন মানবপাচারকারী দালাল শ্রেণির লোকজন। খরচ হিসেবে জনপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত নেয় পাচারকারী চক্র।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাচারকারীরা সাধারণত জনবহুল এলাকা এড়িয়ে মরুভূমি, পাহাড় কিংবা জঙ্গল পথ বেছে নেয়। কারণ, এসব স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি কম। তবে, দুর্গম এসব পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়েন।
মেক্সিকোর সীমান্ত এলাকায় মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী ১৯৯০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত এই ২৯ বছরে প্রায় ছয় হাজারেরও বেশি মরদেহ উদ্ধার করেন। তবে, এর মধ্যে কতজন বাংলাদেশি, তার সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মাইগ্রেশন, মেক্সিকো (আইএনএম) এবং ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই সাত বছরে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে যথাক্রমে ১৪৯, ১৬৭, ৩২৮, ৬৯০, ৬৪৮, ৬৯৭ ও ১২০ বাংলাদেশি আটক হন। তারা বর্তমানে মেক্সিকোর জেলে বন্দি।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো মানুষগুলো আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের কবলে পড়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রে তারা মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন- এটিই সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়।