পাঠকের কথা

‘নদী চিরদিন চিরনিশি রবে অতল আদরে মিশি’–ড. হাসান অরিন্দম

ড. হাসান অরিন্দম, ঝিনাইদহের চোখঃ

নদী মানে দুকূল প্লাবি বয়ে চলা থইথই জলরাশি। নদী মানে আকাশের নিচে স্বপ্নমাখা রুপালি ধারার সঙ্গে ইচ্ছামাফিক খেলা—চিতসাঁতার, ডুবসাঁতার। নদী মানে স্রোতের টানে অপসৃয়মাণ নৌকা থেকে ভেসে আসা ভাটিয়ালি সুর। আমাদের মনে যে স্বর্গের কল্পনা থেকে থেকে দোল খায়, সেখানেও রয়েছে প্রবহমান জলের চঞ্চল ধারা; সেই জলে বিচিত্র মাছেরা খেলা করে। জল ঘিরে বর্ণিল পাখিদের মধুর কলকাকলি। অমরাবতীর নদীভাসা মিষ্টি বাতাস প্রাণের ভেতর কী এক অদ্ভুত আকুল আবেশ গড়ে দেয়, ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকে দূরে। নদীর ওই মায়াবী ধারা আছে বলেই তো কল্পনার স্বর্গ আমাদের এত টানে। অপ্সরাদের চেয়ে স্বপ্নে ওই পাহাড়ি নদীগুলোর প্রেমই আমাদের আরো বেশি করে উচাটন।

সেই সুদূর অতীতে, কত সহস্র বছর আগে কে জানে—সাগরের কাছে পদ্মা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের তীরে তীরে জল-কাদার এই ভূমিতে বাস গেড়েছিল আমাদের অস্ট্রিক-দ্রাবিড় পূর্বপুুরুষ। এরপর কত লড়াই, কত সংগ্রাম নদীতীরে এই ভেজা মাটির বুকে। বনের পাশে তারা পলির বুকে কুটির বানিয়েছে, ফসল বুনেছে, তাদের হাতে ধরা পড়েছে কত বিচিত্র মীন। জলে-স্থলে প্রতিনিয়ত কত লড়াই বাঘ-ভালুক, কুমির আর হাঙরের সঙ্গে। প্রাণের কাছের নদীটি কখনো স্নিগ্ধ-শান্ত, আবার ঝড়ে-ঝঞ্ঝায় কখনো প্রমত্তা-রুদ্র। ঢেউয়ের আঘাতে নদীর কূল ভাঙে—বিলীন হয় বাড়িঘর, ফসলের ক্ষেত, গ্রাম-জনপদ। এর বিপরীতে নদী আঁকে অন্য এক নিপুণ ছবি, স্রোতের সঙ্গে পলি বয়ে এনে এনে নদীর বুকে গড়ে তোলে নতুন নতুন চর, সেসব ভূখণ্ডই হয় একদিন নতুন বসতি, সংগ্রামী মানুষের কোলাহলে সরব হয়ে ওঠে তটভূমি। আবার জেগে ওঠা চর দখল নিয়েও লড়াই-রক্তারক্তির ইতিহাস কম নেই।

সৃষ্টি ও সভ্যতার সাক্ষী এসব নদী বড় খামখেয়ালি। কখনো গতি বদলে নতুন খাত খোঁজে, ভূভাগ ভেঙেচুরে পুরনো জনপদ উজাড় করে গড়ে নেয় নতুন পথ। আবার শতবর্ষ পরে হয়তো ফিরে আসতে চায় সেই পুরনো খাতেই। নদী জন্মায়, নদীর মৃত্যুও হয়। প্রকৃতির খেয়ালে ভূমিকম্প কিংবা প্লাবন একেকটি নদীকে আমূল বদলে দিতে পারে। আবার আমরা এই মানুষরা প্রায়ই নদীর জলে বিষ মেশাই, নদীর গলা চেপে ধরে তার মৃত্যুর কারণ হই। অথচ আমরা জানি, নদী মরে গেলে স্বপ্ন মরে যায়, স্তব্ধ হয় দখিনা হাওয়া। নদীর বুকের ওপর পাথরচাপা দিলে সে-ও নীরবে কাঁদে নির্যাতিতা নারীর মতো। নদীর চাপা আর্তনাদ শুনে কেউ কেউ চোখের জল ফেলে, তার সমব্যথী হয়ে। কিন্তু এতে তো ওর বুকের প্রাণস্পন্দন স্বাভাবিক হয় না।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক আশ্চর্য শৃঙ্খলে বাঁধা। এই দৃশ্যমান প্রকৃতির তাই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আর ধারা রয়েছে। মানুষ নিজের স্বার্থ উদ্ধারে প্রায়ই সেই নিজস্বতায়, সেই আনমনে খেলতে থাকা সদাচঞ্চল সত্তার ওপর আঘাত করে। তখন নদী কিংবা অরণ্যের বেদনায় পাখি আর মাছেরা কেঁদে ওঠে, নিস্তব্ধ হয়ে থাকে সারা আকাশ। এমন অবিমৃশ্যকারিতার প্রতিফল মন্দ হতে বাধ্য। প্রকৃতি কোনো না কোনোভাবে একদিন প্রতিশোধ নেয়ই। নদী তো নারীর মতোই অভিমানী আর কোমল ভীষণ। কিছুতেই তাকে আঘাত করতে নেই। তাকে ভালোবাসতে হয় অকৃত্রিম মমতায়। ওকে যথেচ্ছ ব্যবহারে দিন দিন ওর রক্তনালি বিষে জর্জরিত হয়, বিশীর্ণ হয় গোটা কলেবর—তিলে তিলে ও মরতে থাকে। নদী মুমূর্ষু হলে আমাদের প্রাণের স্ফূর্তি থেমে যায়, পাণ্ডুর হয় সজল সবুজে ছাওয়া মাটি, ফসলের ক্ষেতে বাতাস থেমে যায়, অরণ্য কেঁদে ওঠে, নদী মরে গেলে খানখান হয় আমাদের একান্ত আকাশ।

দুই.

গোটা পৃথিবী আজ ঊর্ধ্বশ্বাসে সমৃদ্ধি নামের উন্মাদ অশ্বের পেছনে নিরন্তর ধাবমান। শিল্প-কৃষি, অবকাঠামো, যোগাযোগ, বাণিজ্য, প্রযুক্তি—সব ক্ষেত্রেই চাই দ্রুত উন্নয়ন। এই উন্নয়নের পেছনে ছুটে আমরা প্রকৃতির স্বাভাবিকতা ও স্বকীয়তার ওপর নির্বিচারে আঘাত করছি। ইট-পাথর, বালু-কংক্রিট, পোল-টাওয়ার, রাসায়নিক বিনষ্ট করছে প্রকৃতির প্রাণময়তা। বস্তুত মানুষের যাবতীয় উন্নতির লক্ষ্য জীবনকে আরো সহজ, সুন্দর আর প্রাণোচ্ছল করা। আমরা যদি চারপাশের পরিবেশকে সুন্দর না রাখি, প্রকৃতির ব্যথার কারণ হই, তবে এই মানবজীবন কিছুতেই কাঙ্ক্ষিত মান লাভ করতে পারবে না; স্বস্তিকর জীবন হয়ে উঠবে সুদূরপরাহত। জীবনকে সুন্দর আর উপভোগ্য করতে চাইলে আমাদের প্রকৃতিকে আঘাত না করে তাকে আরো নির্মল-অকৃত্রিম করে সাজিয়ে তুলতে হবে। প্রকৃতির সবচেয়ে প্রাণবন্ত উপাদান এই নদীগুলোকে প্রবহমান, নির্মল আর সজীব রাখতে প্রথমে স্বার্থচিন্তা ত্যাগ করে ওদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে হবে।

বস্তুত একসময় এই ছিল নদীর তীরবর্তী গ্রামবাংলার চিরপরিচিত রূপ। নদী নিয়ে সে যুগের কবিরা কত কবিতা লিখেছেন, কথাসাহিত্যিক লিখেছেন গল্প-উপন্যাস, শিল্পীর কণ্ঠে উঠে এসেছে নদীর কত গান। অথচ সেই নদীগুলো আজ জীর্ণশীর্ণ, হতশ্রী, মৃত কিংবা মুমূর্ষু। যুগ যুগ ধরে আমাদেরই হাতে নির্যাতিত হয়ে রূপ আর স্বাস্থ্য হারানো নদীগুলো আর আমাদের মন ছুঁয়ে যায় না, সে আজ পথের হতশ্রী ভিখারিনি, তাকে নিয়ে নতুন করে আর কোনো মর্মস্পর্শী কবিতা কিংবা গান সৃষ্টি হয় না।

দূষিত রাসায়নিক আর আবর্জনা-জঞ্জালে ভরপুর নদী যে ভূখণ্ডে থাকে, সে দেশের মানুষের মন নিষ্কলুষ নয়, সেখানকার লোকেরা সমৃদ্ধি পেলেও সুখের দেখা পাবে না। নদীর বুকে বালু ফেলে, নোংরা ঢেলে তার ক্রন্দন উপেক্ষা করে নির্মিত হয় যে অট্টালিকা, যে শিল্প-কারখানা, সেসব নির্মাণ নদীর অভিশাপ নিয়ে আমাদের দুর্যোগই ডেকে আনবে বরং। পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশেরই নদী দূষিত হয়ে একদিন মরতে বসেছিল। তারা অনেকেই নিজেরা ভালোভাবে বাঁচার স্বার্থে অনেক সাধ্য-সাধনায় নদীগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। তারা বুঝেছিল, নদীর দুর্দশা কিংবা মৃত্যু তাদের সুখ-স্বস্তি কেড়ে নিয়ে এক মরুময় পাথুরে দুঃসহ জীবনের ভেতর নিয়ে যাবে।

বাংলার নদীগুলোর ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে। তার কাছে ক্ষমা চেয়ে, স্নেহ, আদর আর শুশ্রূষায় বাঁচিয়ে তোলার আশা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। নদী-নিপীড়কদের তিরস্কারের ভাষা আমাদের জানা নেই, তাদের প্রতি আমাদের অজস্র ধিক্কার। নদীকে আর যথেচ্ছ ব্যবহার নয়, সে ক্রীতদাসী নয় কোনো দিন, তাকে আমাদের পাশে জায়গা দিতে হবে আপনজনের মতো গভীর মমতায়। নদীর সঙ্গে আমাদের যুগযুগান্তরের ভালোবাসায় নিবিড় বন্ধন। সেই বাঁধনে জড়িয়েই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘নদী চিরদিন চিরনিশি/রবে অতল আদরে মিশি।’

লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক

arindam.hasan@gmail.com

সূত্র-কালের কন্ঠ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button