অন্যান্য

কিশোর বয়সীদের বুঝুন

ঝিনাইদহের চোখ:

পনেরো বছরের মেয়ে রাইয়ানা (ছদ্মনাম)। ক্লাস টেনে পড়ে। আগে সে বাবা-মায়ের উপস্থিতিতে টেলিফোনে কথা বলত, এখন সে আলাদা ঘরে গিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে। কী যেন একটা লুকোতে চায় বাবা–মায়ের কাছে। একদিন বাবা-মা আবিষ্কার করলেন, রাইয়ানা একটি ছেলেবন্ধুর সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলছে, বাইরে তার সঙ্গে দেখা করছে। মা-বাবার মনে প্রশ্ন, ‘রাইয়ানা কি প্রেম করছে?’

কিশোরবেলায়, কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক-মানসিক নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। সামাজিক-আবেগীয় (সোশিও ইমোশনাল) বিকাশ হয়। হরমোন আর নিউরোট্রান্সমিটারের প্রভাব এবং শিশুবেলার জ্ঞানীয় বিকাশের (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) মিথস্ক্রিয়ায় তার মধ্যে আবেগের ঝড় তৈরি হয়। কখনো বিপরীত লিঙ্গের কারও প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করতে পারে—কখনো কারও সাহচর্য তাদের ভালো লাগে, আবার কখনো কারও মধ্যে প্রেমের ভাবও উদয় হতে পারে। এটি কিশোর-কিশোরীর স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশপ্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য।

সমস্যা হচ্ছে, এ সময় মা-বাবারা বিষয়টি নিয়ে ভয় পেয়ে যান। তাঁরা উৎকণ্ঠায় ভোগেন, ‘এই বুঝি, আমার ছেলে/মেয়ে প্রেম করে বিগড়ে গেল।’ বিষয়টি বিগড়ে যাবার নয়, বিষয়টি সন্তানের আবেগকে বুঝতে শেখা, তার মধ্যে বয়ে যাওয়া আবেগের ঝড়কে নিয়ন্ত্রণ করা। কোনো বাবা-মা এ সময় সন্তানকে কঠোর শাসন করেন, মোবাইল ফোন কেড়ে নেন, বাসার বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেন, কখনো সন্তানের বিশেষ বন্ধু বা বান্ধবীটিকে হুমকি দেন, তাদের বাবা-মাকে নালিশ করেন। কেউ মারপিটও করেন! কিন্তু এতে করে সন্তানের মঙ্গল হয় না বরং তার আবেগের বহিঃপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তার সামাজিক–আবেগীয় বিকাশ সঠিকভাবে ঘটে না। বাবা-মায়েদের উচিত হবে এ সময় অস্থির না হয়ে
ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, সন্তানের সঙ্গে রূঢ় আচরণ না করা।

এ সময় বাবা-মায়েদের উত্তেজিত হওয়া চলবে না। সে কি প্রেমে পড়েছে, নাকি তার মধ্যে কোনো সাময়িক মোহ তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে সন্তানের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি বুঝে নিন। নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকাতে পারেন, এই বয়সে আপনি কী ভেবেছিলেন, কী করেছিলেন তা মনে করার চেষ্টা করুন। আবার তার সম্পর্কের প্রতি অতি উৎসাহী হয়ে খুব ভালো উদার বাবা-মা হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। মনে রাখতে হবে, আপনার সন্তানের বয়স খুব বেশি নয়, সুতরাং তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর আগে পুরো বিষয়টি আগে বুঝুন। খুব রেগে গিয়ে তার সম্পর্কটি এ মুহূর্তেই শেষ করে ফেলতে হবে, এমনতর আদেশ বা হুমকি তাকে দেবেন না, ধমকাবেন না, মারবেন না।

সন্তানকে অপেক্ষা করতে বলুন, তাকে বোঝান, তার এই বয়স  ক্যারিয়ার আর পড়ালেখা করার বয়স। হুট করে সম্পর্ক ভেঙে ফেলার জন্য চাপ দেবেন না। তবে তার অনুভূতিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিন। যদি মনে করেন, এই সম্পর্ক তার পড়ালেখা বা ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকর হবে, তবে তা সন্তানকে বুঝতে সহায়তা করুন। এই সম্পর্কের কারণে আপনার সন্তান কোনো বিপদে পড়ছে কি না খেয়াল করুন, বিশেষ করে ইন্টারনেট থেকে বিপদ আসতে পারে, তাদের কথোপকথন বা ছবি শেয়ার করার বিষয়ে সতর্ক করুন।

সন্তানের সম্পর্কটিকে অনুমোদন করবেন নাকি করবেন না, সে বিষয়টি সন্তানের অবস্থান, অনুভূতি আর আপনার ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার ওপর নির্ভর করে। তবে যদি অনুমোদন করেন তবে আপনার সন্তানকে কিছু নিয়মরীতি বেঁধে দিন। এ নিয়মগুলো মেনে চলতে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। যেমন রাত জেগে কথা না বলা, বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে না থাকা, ক্লাস-পড়া ফাঁকি না দেওয়া ইত্যাদি। সবার আগে সন্তানের আস্থা অর্জন করুন। যাতে তারা আপনার কাছে তাদের সম্পর্ক এবং এর পরিণতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে। সন্তানের কাছে আপনার বক্তব্য আর মনোভাব স্পষ্ট করতে হবে।

বাবা-মা একে অপরের কাছ থেকে বিষয়টি লুকিয়ে রাখবেন না। পরস্পর আলাপ-আলোচনা করে দুজনকে সমন্বিত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। শারীরিক সম্পর্কের বিষয়গুলো মাথায় রেখে সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই সতর্ক করুন। নৈতিকতা আর নিরাপত্তার বিষয়গুলো তার বয়স উপযোগী করে শেখান। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button