নবগঙ্গা পারের প্রাসাদোপম বাড়িটি..
#ঝিনাইদহের চোখঃ
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর গ্রামে গেলে দেখতে পাওয়া যায় নয়নাভিরাম প্রাসাদোপম একটি বাড়ি।
নবগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে নয় বিঘা জমির ওপর নির্মিত বাড়িটি আজো অনেকের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বাড়িটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে বিদেশী কাঠ ও সৃজনশীল কারুকাজ। বাড়ি থেকে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে নবগঙ্গায়। সে সময়ে নবগঙ্গা প্রমত্তা থাকলেও এখন আর সে রূপটি নেই।
বাড়িটির অপরূপ সৌন্দর্য এখনো গ্রামের মানুষকে বিমোহিত করে। ১৭ কক্ষ বিশিষ্ট প্রাসাদোপম দ্বিতল ভবনের বাড়ীটি এখনও বসবাসযোগ্য এবং সুদৃশ্য। এর নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য প্রতিদিন শতশত দর্শনার্থী হরিশংকরপুর গ্রামে আজো ভিড় জমায়।
জগদ্বিখ্যাত গণিতবিদ অধ্যাপক কালীপদ বসুর (কেপি বসু) জম্মস্থান হরিশংকরপুর গ্রাম। জম্মস্থানের প্রতি তার ছিল ভীষণ টান ও ভালবাসা। আর সেই টানেই নিজ গ্রামে তিনি ১৯০৭ সালে এই প্রাসাদোপম বাড়িটি নির্মাণ করেন।
সময়ের আবর্তে অনেকেই বাড়িটিকে ঐতিহাসিক মনে করছেন। তারা এ বাড়িটি সংস্কার করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন। কারণ, অযত্ন-অবহেলায় কেপি বসুর স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি আজ ধ্বংসের পথে।
হরিশংকরপুরে কালীপদ বসুর জম্ম ১৮৬৫ সালে। পিতা মহিমাচরণ বসু ছিলেন হরিশংকরপুরের তৎকালীন রেজিষ্ট্রি অফিসের ভেন্ডার। তার পুর্ব পুরুষেরা বরিশাল থেকে হরিশংকরপুরে বসতি স্থাপন করেন ।
কেপি বসুর শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় নিজ গ্রামের পাঠশালায়। পরে সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে তিনি ১৮৯২ সালের দিকে ঢাকা কলেজে গণিত শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। অল্প দিনেই তিনি শিক্ষক হিসাবে সুনাম অর্জন করেন। শিক্ষকতা জীবনে তিনি পাঠদানের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি আধুনিক অ্যালজাবরার অধ্যয়ন ও অনুশীলনের পথকে সুগম, প্রাঞ্জল ও সহজ করে তোলেন । এছাড়া তিনি অসংখ্য নতুন অংক উদ্ভাবন করে এ শাস্ত্রের কলেবর বৃদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধন করেছেন। তিনি গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি কলকাতায় কেপি বসু পাবলিশিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি স্বগ্রামের শেথমালা ঘোষকে বিবাহ করেছিলেন । ব্যাক্তিজীবনে দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। মেধা অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের বলে তিনি প্রতিষ্ঠা পান ও প্রচুর অর্থের মালিক হন। আর সেই অর্থই হরিশংকরপুরের নয়নাভিরাম বাড়ি নির্মাণে ব্যয় করেন।
বাড়িটি আজ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ। একটি মহল দখলের অপচেষ্টায় লিপ্ত বলেও কথা উঠেছে। ‘অ্যালজাবরা মেডইজি’, ‘মডার্ণ জিওমেট্রি’, ‘ইন্টারমিডিয়েট সলিড জিওমেট্রি’ প্রণেতা এই ঐতিহাসিক ব্যাক্তিটির একমাত্র স্মৃতিটি রক্ষায় কারো কোন নজর নেই।
১৯১৪ সালে ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃতদেহ ঝিনাইদহ এসে পৌছালে ঝিনাইদহের সকল অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যায়। তার মৃত্যু সংবাদে শোকাভিভূত হাজার হাজার মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ঝিনাইদহ নবগঙ্গা নদীর তীরে উপস্থিত হয়। পরে মৃতদেহটি কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয় । সেখানে নিমতলার শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় ।
তার নাম রক্ষায় শুধু ঝিনাইদহ শহরে তার নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি, তার স্মৃতি রক্ষার্থে এই বাড়িটি হতে পারে একটি দর্শনীয় স্থান।
ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার জানান, কেপি বসুর স্মৃতি রক্ষার্থে তার বাড়িটি সংস্কার করে একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত করার পরিকল্পনা তাদের আছে। কিন্তু অর্থ বরাদ্দের অপ্রতুলতার কারণে সেটি সম্ভব হয়ে উঠছে না।