পেয়েছিলাম ইলা মিত্রের সান্নিধ্য-অশোক ধর
#ঝিনাইদহের চোখঃ
সময়টা খুব বেশি আগের তা নয়। তখনও ট্রানজিস্টারের যুগ পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি, টু-ইন-ওয়ানের যুগ কিছু আগেই শুরু হয়েছে।
শাহবাগের সিলভানা, সিনোরিটা, মৌলিতে তরুণ কবিদের আড্ডা চলে অবিরত, বাংলা কবিতা আবৃত্তির ক্যাসেট তখন বাজারে পাওয়া যায় এবং ক্যাসেটের দোকানিরা জোরে ভলিউম দিয়ে সেগুলো প্রায়ই বাজাতে থাকত।
প্রায় প্রতিদিনই শাহবাগের আড্ডা সেরে হাঁটতে হাঁটতে হাতিরপুলের মেসবাড়িতে ফিরতাম আর ফেরার পথে আবৃত্তি শুনতে শুনতে ফিরতাম। একদিন গীতালি থেকে কিনলাম শম্ভুমিত্র ও দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবৃত্তির ক্যাসেট। সেগুলো আবার দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য TDK-তে রেকর্ডিং করলাম। গোলাম কুদ্দুসের লেখা ‘ইলা মিত্র’ কবিতাটি শোনার সময় শরীর শিউরে উঠত।
ওই একটি কবিতার মধ্যেই ইলা মিত্রের সমগ্র সংগ্রামী জীবনের ছবি মূর্ত হয়ে উঠেছে। আমি তখন বাংলাদেশ সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র, আমাদের কলেজের একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আমি ‘ইলা মিত্র’ কবিতাটি আবৃত্তি করলাম।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যার (তিনি আমাদের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন) বললেন, ‘অশোক খুব ভালো করেছ- তুমি ঝিনাইদহের ছেলে আর ইলা মিত্রও ঝিনাইদহের মেয়ে।’ আমি হতবাক! যে কবিতা শুনতে শুনতে, পড়তে পড়তে শরীরে শিহরণ জাগে, চোখ দিয়ে জল পড়ে অজান্তে, তিনি কিনা আমারই ঝিনাইদহের মেয়ে!
ঝিনাইদহ শহরে এখনকার মতো তখনও খুব বেশি জানাশোনা মানুষ বাস করতেন না অথবা আমার চেনা জগৎটাই ছিল সীমাবদ্ধ; যে কারণে ঝিনাইদহে এসে ইলা মিত্রের খোঁজ করতে পারিনি। এমন এক সময়, কোনো এক সন্ধ্যায় কেসি কলেজ চত্বরে শহীদুর রহমান স্যার (শহীদুর রহমান- কবি, লেখক ও তখন বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক) পরিচয় করিয়ে দিলেন গৌর কিশোর ঘোষের সঙ্গে।
গৌর কিশোর ঘোষের বিখ্যাত সিনেমা ‘সাগিনা মাহাতো’, যার নায়ক নায়িকা দীলিপ কুমার-সায়রা বানু আর হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান আমাদের ঠোঁটে ঠোঁটে ফিরত- ‘ছোটি ছোটি স্বপ্ন হামার’। সেই বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ঝিনাইদহে। কিছুক্ষণ পর জানা গেল, তার বাড়িও ঝিনাইদহে। ইলা মিত্রের কথা তুললে বললেন, ‘কলকাতায় এসো, দেখা হবার ব্যবস্থা করে দেব।’
একবার কলকাতায় যাওয়ার পর আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে ঢুকে গৌর কিশোর ঘোষকে বলি, আপনি বলেছিলেন, ইলা মিত্রের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন।’ সিপিআই অফিসে টেলিফোন করে ইলা মিত্রের ফোন নম্বর নিয়ে আমাকে দিয়ে বললেন, ‘তুমি টেলিফোনে কথা বলে নিও, কোনো অসুবিধা হবে না।’
ফোন করার পর অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো- ‘হ্যালো কে বলছেন?’ বললাম- আমি অশোক ধর, বাড়ি বাংলাদেশের ঝিনাইদহে, ইলা মিত্রের সঙ্গে কথা বলতে চাই। পরের দিন সকালেই তার বাসায় যাত্রার কথা সাব্যস্ত হল এবং তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, কীভাবে তার বাসাতে পৌঁছতে হবে।
সকাল ১০টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম তার দরজায়। বেল চাপতেই দরজা খুলে গেল। মনে হল, তিনি আমারই অপেক্ষায় বসে আছেন এবং সত্যিই তাই।
রমেন্দ্রনাথ মিত্র জমিদার আমলের একটি ইজি চেয়ারে বসা আর তিনি নিজেই দরজা খুললেন। আমি দু’জনকেই প্রণাম করলাম। তিনি আমার হাত ধরে বসতে দিলেন একটি মোড়াতে।
বললেন- ‘আমি সকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার বাড়ি থেকে এই প্রথম কেউ এলো আমার সঙ্গে দেখা করতে। অবশ্য বাংলাদেশ থেকে অনেকেই আসেন কিন্তু ঝিনাইদহ থেকে কেউ আসেনি কোনোদিন।’
একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন পরিবারের অন্য সবার সঙ্গে- তার পুত্র রণেন মিত্র, পুত্রবধূ সুকন্যা মিত্র ও তার নাতি ঋতেন মিত্র। বসার ঘরে আসবাবপত্র হিসেবে যা দেখলাম তা হল, একটি চৌকি, যা আমাদের হাটে কিনতে পাওয়া যায় আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকায়; একটি টেবিল, একটি চেয়ার, একটি বুকসেলফ, দুটি বেতের মোড়া আর জমিদারি আমলের ইজি চেয়ারটি।
এই ইজি চেয়ারটি বাদে সব আসবাবপত্রই অতি সাধারণ; অথচ তিনি ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত চারবার বিধানসভার সদস্য ছিলেন এবং এক মেয়াদে বিধানসভার ডেপুটি লিডার ছিলেন।
তিনি কথা শুরু করলেন- ছোটবেলায় অনেকবার গ্রামে এসেছেন। বললেন- ‘আচ্ছা অশোক, ঝিনেদা শহরে অনেক বড় বড় কড়াইগাছ ছিল, ছোট্ট রাস্তা ছিল ইটের সলিং করা, এখনও কি শহরটা তেমনই আছে?’ আমি বললাম- হ্যাঁ, ঠিক সেরকমই আছে, একবার চলেন না; দেখে আসবেন। বললেন- ‘যেতে তো ইচ্ছে করে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপকালে তিনিও বলেছিলেন বাংলাদেশে যাবার জন্য। মামলার প্রসঙ্গ তুলতেই বঙ্গবন্ধু বললেন- দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে সেসব মামলা-টামলা আর কিছু নাই, আপনি আসেন। কিন্তু অশোক, বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন; এখন যাবো কোন ভরসায়।’
আমি যখন ইলা মিত্রের সঙ্গে দেখা করতে যাই, সময়টা হচ্ছে ১৯৯২ সালের ২১ জুলাই। তিনি আমাকে দুটো বই উপহার দিয়েছিলেন; একটি তার অনুবাদিত ‘হিরোশিমার মেয়ে’ আর একটি মালেকা বেগমের লেখা ‘ইলা মিত্র’। একটিতে লিখে দিয়েছিলেন আর একটি না লিখে বললেন ‘ওটা তো মালেকার, সেখানে আমি কীভাবে লিখব।’
সেই লেখা বই থেকেই সন-তারিখ উদ্ধার করি। সময় গড়াতে থাকে, দুপুর হয়ে যায়- টেবিলে পরম মমতায় আমাকে খাওয়ালেন শান্ত স্নিগ্ধ ইলা মিত্র। অথচ খুনঝরা নাচোলে সেদিন একজন নারীর হুঙ্কারে জেগে উঠেছিল কত না পৌরুষ!
সাংস্কৃতিক কর্মী ও রাজনীতিক, ঝিনাইদহ
সূত্রঃ যুগান্তর