সাধক শিল্পী আরজ আলী বয়াতি
#ঝিনাইদহের চোখঃ
আরজ আলী বয়াতি চলে গেলেন ৫ জুলাই ২০১৯। ঝিনাইদহ থেকে খবর আসার পর থেকেই মাথায় নানা ভাবনা কাজ করতে থাকে। তাকে আমরা তেমন করে চিনি না। তিনি শোবিজ জগতের কেউকেটা নন। তাই তার দেহান্তর কোথাও কোনো আফসোস তৈরি করে না। যদিও বাউল ও বয়াতিরা যে সংস্কৃতির চর্চা করেন; যে নির্লিপ্ত, প্রবৃত্তিবর্জিত, সহিষুষ্ণ জীবনাচারের চর্চা করেন, তা-ই বাংলার মূলধারার প্রতীক হিসেবে বিশ্বময় গৃহীত। এদের বিশিষ্ট সঙ্গীতধারাকে ইউনেস্কো ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
এ জাতীয় বৈশ্বিক ঘোষণার ফলে দেশের এই মৌলিক সংস্কৃতির মর্যাদার স্বীকৃতি আনুষ্ঠানিকতা পেলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মনোযোগ পায় না। আমদানি করা সংস্কৃতিই যেখানে পূজ্য, সেখানে বাউল-ফকির-বয়াতিদের পরম্পরা সহজভাবে বিকশিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি ও অক্ষুণ্ণ রাখতে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগণের পক্ষে ঔদাসীন্য স্বাভাবিক।
আমরা মনে করি, সাধনা-সংস্কৃতির জন্য জীবন উৎসর্গ করা বাউল-বয়াতিদের মর্যাদা প্রদর্শন করার মাধ্যমে সমাজকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা সম্ভব। আরজ আলী বয়াতি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ সুফিসাধক ও বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিচার গানের ‘সেবক’।
তিনি ১৩৬২ বঙ্গাব্দে ঝিনাইদহ জেলার আড়মুখ গ্রামে জন্মেছিলেন। বাল্যকালে একদিন সারিন্দা হাতে আরজ তাদের গ্রামের পাশের বাটুল শিকদারের বাড়ির ‘সাধুসঙ্গ’ আসরে যান। সাধুদের উৎসাহে সেখানে তিনি কয়েকটি গান পরিবেশন করেন। সাধুসঙ্গের ভক্তরা সে গানে মুগ্ধ হয়ে তরুণ আরজের কপালে চন্দনের তিলক এঁকে দেন।
এ ঘটনার কারণে গ্রামের গোঁড়া মুসলমানরা আরজের বাবার মসজিদে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। আরজের বাবার অপরাধ এই যে, তার ছেলে হিন্দুদের ‘সাধুসঙ্গ’ অনুষ্ঠানে গেছে; হিন্দুরা আবার আরজের কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়েছে; এভাবে ছেলে হিন্দু হয়ে গেছে! সমাজের নিষ্ঠুর নিয়মে ক্ষুব্ধ আরজের বাবা আরজের দোতারা সেদিনই ভেঙে ফেলেন এবং ছেলেকে বলেন, ‘গান-বাজনা বাদ দিতি হবে, নয়তো বাড়ি ছাড়তি হবে।’ বাবার কথায় ব্যথিত হয়ে আরজ আলী গৃহত্যাগ করেন সারিন্দা হাতে। ঢাকায় এসে রিকশা-সাইকেল মেকারের কাজ নেন। কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বিচারগানের বিখ্যাত সাধক শিল্পী আবদুল হালিম বয়াতির দীক্ষা নিতে শুরু করেন। আবদুল হালিম বয়াতির ‘তালিমে তাছাউফ’ গ্রহণ করে নিজ সাধনাবলে আরজ আলী বয়াতি হয়ে ওঠেন একজন পরিপূর্ণ সাধক শিল্পী। অবতীর্ণ হন বিচারগানের আসরে।
আরজ আলী বয়াতির জ্ঞান ও সঙ্গীত প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ঝিনাইদহ জেলায় তার বাড়িতে অবস্থান করে বাংলাদেশের সঙ্গীত-সংস্কৃতির ওপর গবেষণার জন্য ক্ষেত্রসমীক্ষণ করেছেন আমেরিকার টেক্সাস ইউনিভার্সিটির সঙ্গীত নৃবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. বেঞ্জামিন ক্রাকাউর। দেশের সীমা অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ এবং দিল্লিতে আরজ আলী বয়াতি বাংলাদেশের সাধনসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।
২০১২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দুই বাংলা’ শিরোনামের সিম্পোজিয়ামে বিজয় সরকারের লেখা এবং আরজ আলী বয়াতির গাওয়া ‘ওপার তুমি এপার আমি মাঝখানে এক সীমারেখা’ গানটির ভিডিওচিত্র দেখে বাংলাপ্রেমী পণ্ডিত ক্লিনটন বি সিলি, হানা রুথ টম্পসন, টনি কে স্টুয়ার্ট, থিবো দুবের, দীপেশ চক্রবর্তী প্রমুখ বিস্ময় প্রকাশ করেন। জীবনের শেষভাগে, সাইমন জাকারিয়া অনূদিত চর্যাগানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন আরজ আলী বয়াতি।
আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, সঙ্গীত ছিল আরজ আলী বয়াতির জ্ঞানচর্চার উপায় মাত্র। সঙ্গীত পরিবেশনের সময় মানবিক, আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও সাধন পদ্ধতির বিভিন্ন স্তর সহজ করে বুঝিয়ে বলতেন গানের বাণী ব্যাখ্যা করার নামে। বয়াতি হিসেবে এই দক্ষতাই তাকে বিশিষ্ট হিসেবে পরিচিত করেছিল। আরজ আলী বয়াতির জীবন সাধনা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতধারাকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
নূরুননবী শান্ত
গল্পকার, গবেষক, অনুবাদক
সূত্রঃ সমকাল