সাবজাল হোসেন, ঝিনাইদহের চোখঃ
উপকুলীয় অঞ্চল না হলেও ঝিনাইদহ কালীগঞ্জে ঘুর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে অসময়ের ঝড়ো বৃষ্টিতে পাকা আমন ধান পড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
দুই দিনের লাগাতর বর্ষায় শীতকালীন আগাম সবজি পঁচতে শুরু করেছে। আর পোল্ট্রির খামারগুলোতে দেখা দিয়েছে ঠান্ডাজনিত নানা রোগ।
তবে কৃষকদের ভাষ্য, শীতকালীন সবজিসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হলেও দীর্ঘ মেয়াদী এবং ব্যয়বহুল পাকা ধানের ক্ষতিটা অপুরনীয়। গো-খাদ্যেরও অভাব দেখা দেবে চরমে। কৃষকেরা বলছেন চলতি আমন মৌসুমের শুরু থেকে ক্ষেতের ধান নিয়ে সমস্যা কাটছেই না। ধান রোপনের পর থেকে অনাবৃষ্টিতে সেচ দিয়েই বাঁচাতে হয়েছে ধানগাছ। পরে বৃষ্টির দেখা মিললেও ধানের বাইল বের হওয়ার সময়ে আক্রমন হলো বাদামী গাছ ফড়িংয়ের। এটা কাটতে না কাটতেই পাকা আধা পাকা ধানগাছ ঝড়োবৃষ্টিতে পড়ে মাটিতে মিশে গেছে। সকল নিচু জমির পড়া ধানের উপর দিয়ে বইছে পানির ¯্রােত। ফলে মৌসুমের শেষ দিকের ঘুর্ণি বাতাসের বৈরি আবহাওয়ায় আমনচাষীরা পড়েছেন চরম বিপাকে।
এমন অবস্থা দেখা দিয়েছে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের সকল এলাকার নিচু মাঠের সবজি ও আমনের ক্ষেতগুলোতে। কৃষি অফিস বলছে কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে। তবে প্রকৃতিতে কারও হাত নেই।
কালীগঞ্জ কৃষি অফিসসূত্রে জানাগেছে, চলতি মোৗসুমে আমন ধান রোপনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার হেক্টোর। কিন্ত চাষ হয়েছে ১৮ হাজার ৫’শত ৫০ হেক্টোর জমিতে।
সরেজমিনে উপজেলার বলিদাপাড়া, দুলালমুন্দিয়া, বারোপাখিয়া, নরেন্দ্রপুর, বলরামপুর, কোলা, খালকুলা, কাবিলপুর, উল্ল্যা, ডাউটি, খেদাপাড়া, কামালহাট, খড়িকাডাঙ্গা, মল্লিকপুর, সাইটবাড়িয়া, মনোহরপুর, রঘুনাথপুর, বেলাট, সাদিকপুর, সুন্দরপুর,আলাইপুর, বালিয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন গ্রামের মাঠে গেলে দেখা যায়, পাকা আধা পাকা ক্ষেতের ধানগাছগুলো ক্ষেতেই শুয়ে পড়েছে। সব নিচু মাঠের পড়ে যাওয়া ধানগাছগুলোর উপরে পানি জমে আছে। কিছু কিছু পাকা ক্ষেতের কাটা ধান জমির কাঁদা মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় মাঠে মাঠে কৃষকেরা দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। আরও দু’একদিন থেমে থেমে থেমে বৃষ্টি হবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের এমন ঘোষনায় কৃষকদের আরও ভাবিয়ে তুলছে।
উপজেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক ইলিয়াস আলী জানান, দুই ভাই মিলে এ বছর সাড়ে ৫ বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন। তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টিতে গভীর নলকূপের সেচে ধানক্ষেত বাঁচাতে হয়েছে। পরে কারেন্ট পোকার আক্রমন কাটিয়ে উঠে পাকা ধান ক্ষেত মাটিতে পড়ে পানির সাথে একাকার হয়ে গেছে। কৃষক ইলিয়াস আরও জানান, হয়তো উচু ক্ষেতগুলোর পড়া ধান ঘরে উঠানো সম্ভব হবে কিন্ত নিচু জমির ধানগুলো পঁচে গলে ক্ষেতেই মিশে যাবে।
ওই গ্রামের কৃষক মাহাবুবুর রহমান ও আব্দুল মান্নান জানান, তারা দুজনেই ধারদেনা করে প্রায় ৪ বিঘা করে আমন ধানের চাষ করেছিলেন। অনেক বাধা পেরিয়ে ক্ষেতের সব ধান পাকা শুরু করেছিল। গত দুই দিনের নি¤œচাপের প্রভাবে বৃষ্টির সাথে ঝড়োবাতাসে মাথা ভারি সব ধান গাছগুলো মাটিতে নুয়ে পড়ে পানির সাথে একাকার হয়ে গেছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি এমন যে, নিচু আমন ক্ষেতের মালিকেরা এবছর খরচের টাকাও তুলতে পারবেন না।
উপজেলার সাদিকপুর গ্রামের কৃষক সাজেদুল ইসলাম জানান, এ বছর মোট ৯ বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন । ক্ষেতের (বি,পি,এইচ) বা কারেন্ট পোকার আক্রমন থেকে কাটিয়ে ওঠার পর পরই অসময়ের ঝড়োবৃষ্টিতে ক্ষেতের সব ধান গাছ পড়ে গেছে। তিনি বলেন, শুধু তার একার নয় তাদের মাঠের বেশিরভাগ পাকা ধান ক্ষেতেরই একই অবস্থা। তিনি বলেন, এখন পড়া ধান ক্ষেতের ধান ঘরে তুলতে কৃষি শ্রমিক পাওয়া নিয়ে প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে। প্রতি বিঘা ধান ঘরে তুলতে শ্রমিকদেরকে কমপক্ষে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা বেশি দিতে চাচ্ছে। তারপরও সকলেই আগে ধান ঘরে তুলতে চাচ্ছেন। সুযোগ বুঝে এক শ্রেণীর শ্রমিকেরা মজুরী হাকাচ্ছেন আকাশ ছোয়া। ফলে আমন চাষীরা ক্ষেতের ধান নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে।
উপজেলার সাইটবাড়িয়া গ্রামের সবজি চাষী নান্নু মিয়া জানান, ঘুর্নিঝড় বুলবুলের প্রচন্ড গতির ঝড়ো হাওয়া এ এলাকায় আসেনি। তবে মধ্যম দমকা হাওয়ার সাথে লাগাতর দুই দিনের বৃষ্টিতে শীতকালীন সবজির ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, এ বছর আগাম শীতকালীন ১৮ কাঠা জমিতে মুলা চাষ করেছিলেন। লাগাতর বর্ষায় মুলা পঁচতে শুরু করেছে।
উপজেলার ফুলবাড়ি গ্রামের মরিচ চাষী এমদাদ হোসেন জানান, দুই দিনের লাগাতর বর্ষায় ক্ষেতের মরিচ গাছ মরতে শুরু করেছে। ধরন্ত ক্ষেতের এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কষ্টকর।
একই গ্রামের পটলচাষী আব্দুর রশিদ জানান, ধরন্ত পটল ক্ষেতের গাছ বর্ষার পানিতে মরে যাচ্ছে। এখন কি করে ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন সে চিন্তায় পড়েছেন।
কালীগঞ্জের পোল্ট্রি খামারী তানভীর হোসেন প্রিন্স জানান, লাগাতর বর্ষা আর ঠান্ডা বাতাসে খামারের পোল্ট্রিগুলোর মধ্যে ঠান্ডাজনিত রোগ দেখা দিয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, বৈরি আবহাওয়ার প্রভাবে উপজেলার বিভিন্ন মাঠের পাকা ধান ক্ষেতের ধান গাছ পড়ে যাওয়ার খবর তিনি শুনেছেন। তিনি খবর নিয়েছেন নিচু জমির মাথা ভারি পাকা ধানগাছ বেশি পড়েছে। তিনি বলেন প্রকৃতিতে কারও হাত নেই। এতে কৃষকদের শ্রমিক ব্যয় বেশ কিছুটা বাড়বে। আর বৃষ্টি না হলে ফলন বিপর্যয় হবে বলে তিনি মনে করেন না।