মহেশ্বরচাঁদা বাজার করে চকচক, পরিষ্কারের ঝাঁড়ু কৃষক হেলাল উদ্দিনে হাতে
ঝিনাইদহের চোখঃ
ভোর হলেই ঝাঁড়– হাতে বেরিয়ে পড়েন কৃষক হেলাল উদ্দিন। প্রথমে গ্রামের মসজিদ থেকে নামাজ আদায় করে নেন, এরপর শুরু হয় বাজার ঝাড় দেওয়ার কাজ। এরাস্তা-ওরাস্তা, এগলি-ওগলি সবই নিজ হাতে পরিষ্কার করেন। ১৯৯৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হওয়ার পর থেকে তিনি এই ঝাঁড়– দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন। মহেশ্বরচাঁদা নামের ছোট বাজারটি তাই সারাক্ষন থাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
স্থানিয়রা বলছেন, হেলাল উদ্দিন বাড়িতে আছেন, না কোথাও বেড়াতে গেছেন তা বোঝা যায় বাজারটি দেখার পর। বাজার পরিষ্কার থাকলে তারা বুঝতে পারেন হেলাল বাড়িতে আছেন, আর অ-পরিষ্কার দেখলে বোঝেন বাইরে বেড়াতে গেছেন। কৃষক হেলাল উদ্দিন সম্পূর্ণ ফ্রি এই বাজার পরিষ্কারের কাজটি করেন। বাজার ঝাঁড়– দেওয়ার বিনিময়ে তাকে কেউ একটা চা খেতে বললেও তিনি খান না। সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ভাবে তিনি এই কাজটি বরে যাচ্ছেন, যার কারনে সকলের কাছে প্রশংসা পেয়েছে বলে জানান স্থানিয়রা।
হেলাল উদ্দিন (৭১) ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের মৃত ফকির আলীর পুত্র। পেশায় তিনি কৃষক, কৃষি কাজ করে সংসার চালান। তার স্ত্রী মাহিরন নেছা আর চার মেয়ে, তিন ছেলের সংসার। ছেলে-মেয়েরা বিয়ে করেছেন। হেলাল উদ্দিন বলেন, দরিদ্র পরিবারে তাদের জন্ম। তারা তিন ভাই, এক বোন। বাবার ৭০ শতক জমি ছিল। যেখানে ঠিকমতো চাষাবাদ হতো না। বড় ভাই দেলবার আলী ১৯৭১ সালে কলেরায় আক্রন্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। আরেক ভাই খেলাফত আলী ক্যান্সারে মারা যান। তিনি আর একটি বোন বেঁচে আছেন।
হেলাল উদ্দিন আরো বলেন, সংসারে অভাব থাকায় পড়ালেখা ছেড়ে ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে মাঠের কাজে যেতে হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। বাবা উপজেলার জটারপাড়া গ্রামে তাদে বিয়ে দেন। সংসাবে অভাব থাকায় স্ত্রী জামেনা বেগম চলে যান। পরে মাহিরন নেছাকে বিয়ে করেন। কৃষি কাজ করেই বর্তমানে তার সংসার ভালোই চলছে।
কৃষক হেলাল উদ্দিন জানান, ছোট থেকেই তিনি সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। ১৯৯০ সালে কৃষকের মুক্তির জন্য কাজ শুরু করেন। কৃষক নেতা মরহুম ওমর আলীর নেতৃত্বে তারা অনেকে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সম্মিলিত ভাবে, বিজ্ঞান ভিত্তিক চাষাবাদ করে এলাকার কৃষকের মুক্তি এনেছিলেন। যারা এক সময় খেতে পাননি তারাও স্বাভলম্বি হয়েছে। তাদের এই কাজে সহযোগিতা করেছেন দেশের কিছু কৃষি বিজ্ঞানীরা।
আর এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে ১৯৯৬ সালে তাদের গ্রাম কালীগঞ্জের মহেশ্বরচাঁদায় কৃষি ক্লাব প্রতিষ্ঠা সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঘিরে ওই বছরই গড়ে ওঠে বাজার। যার নাম মহেশ্বরচাঁদা বাজার। হেলাল উদ্দিন জানান, যে বছর বাজার প্রতিষ্ঠা হয়, ওই বছরই তিনি নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ৬ ওয়ার্ডে মেম্বার নির্বাচিত হন। এরপর তিনি জনগনের সেবা করতে নানা কাজের সঙ্গে বাজার পরিষ্কার করাও শুরু করেন। সেই থেকে প্রতিদিন ভোরে তিনি এই বাজারটি পরিষ্কার করেন। বাড়ি থেকে ঝাটা নিয়ে ভোরে বের হন, এরপর ফজরের নামাজ আদায় করেন। তারপর চলে যান ঝাঁড় দেওয়ার কাজে। গোটা বাজার তিনি একাই পরিষ্কার করেন। বাজারের পাশ্ববর্তী রাস্তাগুলোর অনেকটা অংশ ঝাঁড়– দেন তিনি।
ওই বাজারের পাশের বাসিন্দা আব্দুল সালেক জানান, কৃষক হেলাল উদ্দিন তাদের এলাকার সকলের কাছে প্রিয় একটি মানুষ। তিনি এলাকার মানুষকে নানা ক্ষেত্রে পথ দেখিয়েছেন। নিজ বাড়িতে কেঁচো সার তৈরী করেন আর সবাইকে প্রশিক্ষন দিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া বিষমুক্ত সবজি চাষে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি ইতিমধ্যে কৃষিতে অবদান রাখায় বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক লাভ করেছেন। এছাড়াও তিনি নিজে পড়ালেখা করতে না পারলেও এলাকার সব গুণি মানুষের জীবন নিয়ে ডায়েরী লেখেন। বাজারের দোকানদার আব্দুল আজিজ জানান, কৃষক হেলাল উদ্দিনের কারনে তারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাজার পেয়ে থাকেন। হেলাল আসলে মানুষের কল্যানেই সব সময় কাজ করে থাকেন।
এ বিষয়ে নিয়ামতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রনি লষ্কার জানান, হেলাল উদ্দিন সব ভালো কাজের সঙ্গেই থাকেন। নিয়মিত বাজার ঝাঁড় দেওয়া ছাড়াও আরো অনেক কাজ তিনি মানুষের কল্যানে করে যাচ্ছেন। সমাজ ও এলাকার মানুষের জন্য তার এই কাজ অন্যদের উৎসাহ জোগায়।