কালীগঞ্জের খোর্দ্দ তালিয়ান গ্রামে শতভাগ নলকূপ আর্সেনিকযুক্ত, আক্রান্ত ১৮
ঝিনাইদহের চোখঃ
দিন যত পার হচ্ছে গ্রামের লোকজন আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এমন অবস্থা বিরাজ করছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার খোর্দ্দ তালিয়ান গ্রামে।
গ্রামবাসীদের ভাষ্য, এ পর্যন্ত গ্রামটিতে ১৮ জন নারী-পুরুষ আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে গত বছর হেলাল উদ্দীন (৭৫) নামের একজন মারা গেছেন। গ্রামটিতে খাবার পানির জন্য সরকারীভাবে মোট ৮ টি আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ঠ নয়। তারপরও সচেতনতার অভাবে গ্রামবাসীদের অনেকে এখনও প্রতিনিয়ত এ আর্সেনিক বিষযুক্ত পানি পান করে চলেছেন কালীগঞ্জ উপজেলার খোর্দ্দ তালিয়ান গ্রামের বাসিন্দারা।
কালীগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জরিপ মতে, কালীগঞ্জ উপজেলায় মোট ২৯ হাজার ৫শ ৬৩ টি অগভীর নলকূপ রয়েছে। এরমধ্যে ২৬ হাজার ৬শ ১৩ টি আর্সেনিক দূষণমুক্ত। আর দূষনযুক্ত ২ হাজার ৯শ ৫০ টি নলকূপ। তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ উপজেলাতে মোট ২৯ জন আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত রোগীকে চিহ্নিত করা হয়। যার মধ্যে ২ হাজার ৬শ ১৩ জন বাসিন্দার গ্রাম উপজেলার তালিয়ানে ছিল মাত্র একজন রোগী। কিন্ত গ্রামটিতে পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় মোট ১১৯ টি খাবার পানির নলকূপের সবগুলোই আর্সেনিকযুক্ত। এরপর থেকে গ্রামটিতে সরকারীভাবে মোট ৮ টি আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।
সরেজমিনে কালীগঞ্জ উপজেলার সর্বশেষ জামাল ইউনিয়নের খর্দ্দ তালিয়ান গ্রামটিতে ৮ টি আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ রয়েছে। গ্রামের অনেকের শরীরের বিভিন্ন স্থানে চর্ম জাতীয় রোগ রয়েছে। এরপর ২০০৯ সালে এনজিও ফোরামের উদ্যোগে আইসিবি এমপি প্রকল্পের আওতায় আর্সেনিকোসিস রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সে সময়ে এ গ্রামের বয়োবৃদ্ধ হেলাল উদ্দীন (৬২), ইউসুফ মন্ডল (৭০), আব্দুল মজিদ মুন্সি (৬৫), ময়নদ্দিন মিয়া (৫৭) ও তার স্ত্রী সখিনা বেগম (৪৮), ওই গ্রামের ইসলাম মন্ডল (৬৪) ও তার পুত্র লিয়াকত আলী (৩৭), সালেহা বেগম (৪২), জরিনা বেগম (৪৮), আব্দুল বারেক মন্ডল (৭২), জিতেন্দ্রনাথ বিশ্বাস (৬৫) ও তার স্ত্রী অহল্লা বিশ্বাস (৫০), শহীদুল্লাহ বিশ্বাস (৫০), নিধির মালাকারসহ (৪৮) মোট ১৮ জনকে এ রোগে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়। অবশ্য এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে ধারণা করছেন গ্রামবাসী।
গত বছর আর্সেনিকে আক্রান্তে সারা শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে মারা গেছেন হেলাল উদ্দীন। আর ইউসুফ মন্ডল এ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তবে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন আর্সেনিকোসিসে নয় বার্ধক্যজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। কেননা তিনি আর্সেনিকোসিসের চিকিৎসা ও নিয়ম মেনে চলে বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।
আক্রান্তদের একজন ইসলাম মন্ডল জানান, ছোট বেলায় তাদের নিজেদের বাড়িতে থাকা কূপের পানি পান করতেন। তার বাপ-দাদারাও কূপের পানি খেয়ে সুস্থভাবে জীবন-যাবন করে গেছেন। পরে অগভীর নলকুপ স্থাপন করে তারা প্রায় ৪০ বছর ধরে পানি পান করছেন। তখন কোন অসুবিধা হয়নি। অথচ গত ২০০৬ সালের দিকে হঠাৎ একদিন দেখেন তার, পিঠে, কোমরের নীচে ও হাতের তালুতে চুলকাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে তা শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রথমে ভেবেছিলেন সাধারণ খোসপাঁচড়া জাতীয় অ্যালার্জি হতে পারে। কিন্ত সময় গড়ানোর সাথে সাথে গ্রামের আরও অনেকের শরীরে একই ধরণের অ্যালার্জি ছড়িয়ে পড়ছিল। এরপর ২০০৯ সালে তাদের গ্রামে এনজিওর কর্মীরা এসে পানি পরীক্ষা করার মাধ্যমে চিহ্নিত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিলেন। তিনি তাদের নিকট চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। কিন্ত কিছুদিন পরে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা খানিকটা বিপাকে পড়েন। এরপর হাসপাতালে গিয়ে কয়েক দফা চিকিৎসকেব পরামর্শ নিয়ে এখন কিছুটা ভালো আছেন। তবে কোমরের পাশ দিয়ে কালো দাগের অ্যালার্জি ছড়িয়ে পড়েছে।
একইভাবে আব্দুল মজিদ মুন্সি জানান, অনেক আগেই তিনি অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথম দিকে হাতের কনুতে অল্প অল্প চুলকানি দেখা দিয়েছিল। এখন সারা পিঠে ফোটাফোটা অ্যালার্জিতে ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাময়ের জন্য ঔষধ খাচ্ছেন। ওই গ্রামের বাসিন্দা ২ নং জামাল ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জয়নাল মন্ডল জানান, আজ থেকে ১৪/১৫ বছর আগে তাদের গ্রামে নলকূপ স্থাপন করতে এসে নতুন নলকূপের পানি দেখে মিস্ত্রিরা বলেছিলেন এ গ্রামের নলকূপের পানিতে আর্সেনিক থাকতে পারে। তখন গ্রামবাসী কর্ণপাত না করলেও পরবর্তীতে নলকূপগুলোর পানি পরীক্ষা করলে ধরা পড়ে যে গ্রামের শতভাগ নলকূপে আর্সেনিক রয়েছে। ফলে সে সময়ে তারা নলকূপগুলোতে লাল রংয়ের চিহ্ন দিয়ে যান সাথে সাথে এগুলোর পানি পান না করার পরামর্শ দেন। তখন থেকে গ্রামের মানুষ সরকারিভাবে আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্ত বিশুদ্ধ খাবার পানির চাহিদা মেটাতে তাদের গ্রামে যে কয়টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
তিনি আরো জানান, প্রথম পর্যায়ে গ্রামবাসী এটার ব্যাপারে খুব বেশি একটা গুরুত্ব দেননি। কিন্ত সময় গড়ানোর সাথে সাথে অর্সেনিকোসিসে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমানে তাদের গ্রামে ১৮ জন আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগী রয়েছে।
এ ব্যাপারে ২ নং জামাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোদাচ্ছের হোসেন মন্ডল জানান, তার ইউনিয়নের মধ্যে খোর্দ্দ তালিয়ান একটি অনুন্নত ও কৃষিনির্ভর গ্রাম। গ্রামের শতভাগ নলকূপে আর্সেনিক থাকায় তিনি বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য ওই গ্রামটিতে কয়েকটি আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন। তিনি আরও বলেন, এ গ্রামটির পাশের নাটোপাড়া গ্রামের নলকূপেও ব্যাপকভাবে আর্সেনিক রয়েছে। নিরাপদ খাবার পানির জন্য আর্সেনিকমুক্ত নলকূপের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপসহকারী প্রকৌশলী জেসমিন আরা জানান, এ উপজেলায় আর্সেনিকের উপর ২০০৩ সালে জরিপ হয়েছে। তখন উপজেলাতে আর্সেনিকোসিসে মোট ১৬১ জন আক্রান্ত রোগী ছিল। দীর্ঘ সময় জরিপ না হওয়ায় এখনকার সঠিক পরিসংখ্যান তিনি জানেন না। তিনি আরও জানান, উপজেলার জামাল ইউনিয়নের খোর্দ্দ তালিয়ান গ্রামে শতভাগ নলকূপে আর্সেনিক রয়েছে এটা তিনি জানেন। যে কারনে ওই গ্রামটিতে বেশ কয়েকটি আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ দেয়া হয়েছে। এখন এ ইউনিয়নের খোর্দ্দতালিয়ান গ্রামেই এখন বেশ কিছু রোগী আছে বলে তিনি শুনেছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডঃ শামীমা শারমিন লুবনা জানান, কেউ যদি দীর্ঘদিন ধরে আর্সেনিক দূষনযুক্ত পানি পান করেন তাহলে আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে এবং আরোগ্য লাভে দীর্ঘ সময় লাগে। তিনি জানান, নিরাপদ পানি পান, প্রচুর শাক সবজি এবং পুষ্টিকর খাবার আরোগ্য লাভে সহায়তা করে। এ রোগ বংশগত বা ছোঁয়াচে নয় ফলে এ রোগীদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করা উচিৎ। এ রোগের কারণে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলেও জানান তিনি।