জানা-অজানা

প্রশংসায় ভাসছে ‘কেরালা মডেল’, যা শিখতে পারে গোটা বিশ্ব

ঝিনাইদহের চোখঃ
বিশ্বের বহু দেশে সম্পূর্ণরূপেj চলছে। বন্ধ আন্তর্জাতিক সীমান্ত।আকাশপথ পুরোপুরি বন্ধ। ব্যবসা বাণিজ্যেও হাড়ির হাল। বিমান যোগাযোগও স্থবির হয়ে পড়েছে।কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে এ স্থবিরতা স্বাভাবিক হতে দু’বছরের মতো সময় লাগতে পারে বলে মনে করছে বৈশ্বিক ভ্রমণবিষয়ক গবেষণা সংস্থাগুলো।এ পরিস্থিতিতে এমন আশঙ্কা রয়েছ যে, কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণের প্রভাবে বড় সংকটে পড়বে।তবে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ভারতের কেরালা রাজ্যের গৃহীত পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে আলোচিত হচ্ছে। প্রশংসায় ভাসছে ‘কেরালা মডেল’।

ব্যাপক হারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা লোকজনকে দ্রুত খুঁজে বের করা, দীর্ঘ সময় কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থার পাশাপাশি হঠাৎ লকডাউনের কারণে আটকে পড়া হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিকের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা ও কয়েক লাখ শ্রমিকের কাছে নিয়মিত খাবার পৌঁছানোর মতো মানবিক উদ্যোগের কারণেই করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছে কেরালা। তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো কীভাবে পুরো বিশ্বের জন্য করোনা মোকাবিলায় শিক্ষণীয় হতে পারে, তা তুলে ধরা হয়েছে এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ।

এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) একটি সাময়িকী। ১৮৯৯ সাল থেকে প্রকাশিত এই সাময়িকীর সম্পাদকীয় স্বাধীনতা আছে এবং এমআইটি এ ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ করে না।

এমআইটির বিশ্লেষণে বলা হয়, কেরালায় অভিবাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীরা নিয়মিত যাতায়াত করেন। নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে কেরালাতেও শুরু হয়েছিল সংকট। চীনের উহান থেকে আসা এক মেডিকেল শিক্ষার্থী প্রথম সেখানে করোনা রোগী হিসেবে শনাক্ত হন। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ওই রোগী শনাক্ত হওয়ার আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে। তারা আগে থেকেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে করণীয় ও কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিল। করোনার আক্রমণ টের পাওয়ার পরপরই তারা কাজে নেমে পড়ে।

ভয়াবহ মহামারির বিরুদ্ধে অবশ্য কেরালার আগে থেকেই লড়াই করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০১৮ সালে নিপা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে কেরালাকে। বাদুড় থেকে উদ্ভূত ওই ভাইরাস মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়েছিল। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আলোকে কেরালা এবার প্রস্তুত ছিল। করোনাভাইরাসের যেখানে কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই, সেখানে কেরালা এর প্রতিরোধে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা অনুকরণীয়। প্রযুক্তিগত ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এ মহামারি ব্যবস্থাপনার জন্য কেরালাকে ‘সাফল্যের মডেল’ হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করছে।

এমআইটির প্রতিবেদনে বলা হয়, কেরালা খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পেরেছে বলে তারা অনেকটাই এগিয়েছে। সংক্রামক রোগের মহামারি ঠেকানোর উপায় হচ্ছে ব্যাপক হারে পরীক্ষা, আইসোলেশন, সংস্পর্শে আসাদের শনাক্তকরণ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। সব কটিতেই কেরালা দুর্দান্ত সাফল্য দেখিয়েছে। একদিকে যেমন অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, অন্যদিকে মানবিকতাও দেখিয়েছে। এর আগে নিপা ও জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছে ভারতের এই রাজ্যটি।

কেরালার কাছ থেকে শিক্ষণীয়

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী শুরু থেকেই ব্যাপক হারে পরীক্ষা, আইসোলেশন, সংস্পর্শে আসাদের শনাক্তকরণ ও নজরদারি বাড়ানোর কাজ করেছে কেরালার সরকারি কর্মকর্তারা। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউর তথ্য অনুযায়ী, ভাইরাসের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কোনো গড়িমসি করেননি তারা। সবার আগে সাড়া দেন কেরালার পঠনমথিত্তা জেলার দায়িত্বে নিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তা নোহ পুলিচিলিল বাভা। তিনি স্বাস্থ্যসচিবের অধীনে কাজ করেন। প্রয়োজনীয় উপকরণের স্বল্পতা থাকলেও তাঁদের লক্ষ্য ছিল সংক্রমণ ঠেকাতে চেইন বা শৃঙ্খল ভেঙে দেওয়া। তাই তাঁরা দ্রুত সংক্রমিত ব্যক্তিদের খুঁজে আলাদা করে ফেলেন।
গোয়েন্দা কর্মসূচি ৪০ বছর বয়সী নুহ তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে এ পরিস্থিতিতে সবার আগে মানুষকে কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করেন। তিনি পুরোনো দিনের গোয়েন্দা কার্যক্রম ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে কে কার সংস্পর্শে এসেছে তা খুঁজে বের করেন। তিনি ৫০ জন পুলিশ কর্মকর্তা, প্যারামেডিকস, স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে কয়েকটি দলে ভাগ করেন। তিনি সবাইকে সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা প্রত্যেককে খুঁজে বের করতে বলেন। এর বাইরে জিপিএস তথ্য, বিমানবন্দর, রাস্তা, দোকান প্রভৃতি জায়গা থেকে নেওয়া নজরদারির বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংক্রমিত ব্যক্তির চলাফেরাসহ তাঁর সংস্পর্শে আসা সবার তথ্য পাওয়া যায়।

রাজ্যের সহযোগিতা কেরালায় কেবল পুলিশের কর্মকাণ্ডই নয়, সেখানে রাজ্য সরকার ব্যাপক সহযোগিতা করেছে। কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে ‘করোনাভাইরাস ঘাতক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর পাশাপাশি বাকি ভারত যখন করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে শৈলজা দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন। গত জানুয়ারিতে চারটি বিমানবন্দরে তিনি যাত্রীদের পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যাদের উপসর্গ ছিল, তাদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় নেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি ২৪ সদস্যের একটি টিম গঠন করেন, যাতে পুলিশ ও কেরালার বিভিন্ন বিভাগের সরকারি কর্মকর্তারা যুক্ত রয়েছেন। কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার চেষ্টা করছি। এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে আগামী সপ্তাহে কী হবে, তা বলা যাচ্ছে না। তাই এখনই স্বস্তির কোনো সুযোগ নেই।’

সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা ৯ মার্চ নাগাদ কেরালায় একটি পরিবার করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার খবর পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই নুহের টিমের কাছে তাদের যাতায়াতের সব জায়গার ম্যাপ চলে আসে। এসব তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মানুষকে একটা হটলাইন নম্বর দেওয়া হয়। ওই পরিবারের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের যোগাযোগ করতে বলা হয়। ৩০০ মানুষের সঙ্গে ওই পরিবারে সাক্ষাৎ হয়। এসব মানুষকে শনাক্ত করে তাদের আইসোলেশন করা হয়। সেলফ আইসোলেশন সংখ্যা ১ হাজার ২০০ হয়ে যায় দ্রুত। নুহ একটি কল সেন্টার স্থাপন করে ৬০ জন মেডিকেল শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। আইসোলেশনে থাকা প্রতিটি ব্যক্তিকে প্রতিদিন কল করা হতো। তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ নেওয়া হতো। তাঁরা ঠিক বলছেন কি না, তাও পরীক্ষা করা হতো। ঠিক না বললে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। পুলিশের পক্ষ থেকে আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়। পুরো জেলাকে উচ্চ সতর্কব্যবস্থায় রাখা হয়। তারা হাত মেলানোর পরিবর্তে নমস্কার জানানোর প্রচলন করে। এ কারণে কেরালা এখন গ্রাউন্ড জিরো।

নেতৃত্বের প্রদর্শন ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে মহামারি ঘোষণা দিল। এর পরদিনই ভারতে একজন মারা গেল। পুরো ভারতজুড়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেখানে করণীয় কী ঠিক করতে ব্যর্থ, সেখানে কেরালায় ভিন্ন ধরনের নেতৃত্ব দেখা গলে। ১৫ জন সংক্রমণের শিকার হলেও কেরালা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন লকডাউন ঘোষণা করে দেন। তিনি প্রতিদিন মিডিয়া ব্রিফিং করেন। ইন্টারনেট সেবা বাড়ানোর কথা বলেছেন তিনি। তাঁর কার্যকলাপ জনসাধারণের ভয় কমিয়ে আস্থা তৈরি করেছে।

প্রত্যেকের অংশগ্রহণ ৩১ মার্চ নাগাদ ভারতে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা ১ হাজার ৬৩৭ হয়ে যায়। এর মধ্যে কেরালায় সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়ায় ২১৫। এখনো সেখানে সংক্রমিত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা মানুষকে খুঁজে বের করে পৃথক করা হচ্ছে। পঠনমথিত্তা জেলায় এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষকে আইসোলেশন করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে খাদ্য–সংকটসহ অন্যান্য সংকট মোকাবিলায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন নুহ। ২৩ দিন আগেও যে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি এখন কাজের চাপ থাকলেও একে সুযোগ হিসেবে দেখতে চান সরকারি এ কর্মকর্তা। তার মতে, ‘আমরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে কখনো পড়িনি। চলুন দেখা যাক আমরা কী করতে পারি।’

প্রসঙ্গত, বিশ্বের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা এখন ২১ লাখ ২৯ হাজার ৯২৭ জন। বিশ্বে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৯৬ জন, মারা গেছে চার হাজার ৯৭ জন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪২ হাজার ৭১৬ জন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button