সিঙ্গেল প্যারেন্টস !—–তারিকুল ইসলাম পলাশ (এইড ফাউন্ডেশন, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী)
ঝিনাইদহের চোখ-
সাধারণত মা-বাবা উভয় সুসমন্বয়ের মধ্যমে সন্তানদের গড়ে তোলে,বিকশিত হতে সহায়তা করে। তবে,পরিবার-পরিজন-প্রতিবেশী শিশুর মনোজগত গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখে,তা অনেকেই ভুলে যায়। সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের সন্তান লালন-পালনে,টু ইন ওয়ানের ভূমিকা পালন করতে হয়। তাই তাদের সাথে সন্তানদের সম্পর্ক অন্যরকম হয়,যা বর্ণনাতীত। অভিজ্ঞতার সাথে নবীণ মেধার কিছু মতপার্থক্য সবসময় চলতেই থেকে। তাইতো জীবনে চলার বাঁকে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেক কিছুই করতে হয়, যার ব্যাখ্যা তাৎক্ষণিক বোঝানো সম্ভব নয়। তাইতো সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের সন্তান লালন-পালনে সমাজ-প্রকৃতি-পরিবেশ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়।
সচেতন ভাবই পরিবারে, প্রক্রিয়াজাত বা ফাস্টফুডের প্রচলন সীমিত। শিশুকালে,হঠাৎ একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে অঙ্গন( Fardin Anam Aungon) চিপস কেনার বায়না ধরলে,তখনকার অফিসের সামনে শংকর’দার দোকানে, চিপস হাতে নিয়েই বিজ্ঞাপনে প্রদর্শিত গিফট খেলনা চায়। তখনও নতুন চালান ঝিনেদাতে আসেনি। কে শোনে কার কথা ‘টিভি’তে কি মিথ্যা কথা বলে?’ শংকর’দা সেই খেলনা সহনীয় সময়ের মধ্যে কিভাবে যেন সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন।
MCSK’তে ভর্তির জন্য ব্লাড গ্রুপের প্রয়োজন হয়। তখন ছেলেটি শিশুর মতোই বলেছিলো ‘তোমার আর আম্মুর যেহেতু O+ আমারও তাই হবে, আমি ব্লাড গ্রুপ করবো না’! ছলচাতুরি কৌশল অবলম্বন করে প্যাথলজিতে নেওয়া হয়েছিল দুই ভাইকেই। ঠিক পেয়ে স্বনন(Fayaz Shonon) ভোঁদৌড়, প্যাথলজির লোকদের বিষয়টি পূর্বে অবগত করা ছিল বিধায় নানা নাটকীয়তার মধ্যে কাজটি সম্পন্ন হয়! বুঝে উঠার আগেই অঙ্গনের ব্লাড নেওয়া হয়ে যায়। তখন, ওর সাথে কেন মিথ্যা বলা হলো সেটাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়,সে এক জটিল পরিস্থিতি ! তারপর,হাওয়া হয়েছিল অর্ধ দিন, তন্ন তন্ন করে খুঁজে শেষ পর্যন্ত মিলেছিল বাড়ির পাশে নির্জন মাঠের মাঝে পুকুর পাড়ে বরকত মৌলভীর পরিত্যক্ত টিনশেডের বাড়ির বারান্দায়,মাথা নীচু করে নিশ্চুপ একা বসা! ক্ষুধা-পিপাসায় ঠোঁট দুটি শুকনা কাঠ..! এমন অভিমান করে,এক জায়গায় দীর্ঘ সময় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকার ম্যারাথন অভিজ্ঞতা তার আছে ! ব্লাড গ্রুপ রিপোর্ট হাতে-পেয়ে বলেছিল,’বলেছিলাম না তোমাকে,খামাখা কষ্ট দিলে’ হোক না,যার বুঝ সে নিয়েই থাকুক না! সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের তাই অনেক সময়,সন্তানদের শিশুতোষ যুক্তির বিতর্ক এড়িয়ে সমাজ ও পরিবেশের উপরে অনেক কিছুই সমাধানের ভার ছেড়ে দিতে হয়।
ছেলেটি একসময় পাঠ্য পুস্তক থেকে অন্য বিষয়ে বেশি মনোযোগী ছিলো,পাঠ্য বিষয়ে মনোনিবেশে উৎসাহ দিতে JSC’তে গোল্ডেন পেলে সেল ফোন দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল । আশানুরূপ ফলাফল হলো,আগেই নেট ঘেটে এমন ফোন নির্বাচন করেছিল,যা তখনও দেশেই এসে পৌঁছয়নি। তা নিয়ে কত কান্ড কীর্তি। নবম শ্রেণীতে পড়র সময় লক্ষ্যস্থির,কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে পড়বে। তাই চতুর্থ বিষয় হিসাবে জীববিজ্ঞান এর পরিবর্তে ICT নিয়েছিল। সেই কারণে, নটরডেম ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে ওঠে,তা নিয়ে কতো কি…
ছুটির পর প্রথম দিকে শান্তশিষ্ট ভাবে কোনদিন, MCSK’তে গেছে বলে মনে পড়ে না। সে এক নিদারুণ কষ্টের অনুভূতি। একবার ছুটির সময় ভারতের,ভিসার জন্য ধানমন্ডির সেন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল অনেক সময়। প্রচন্ড গরম তার উপর কড়া রোদ। বলেছিলাম,আমি দাঁড়িয়ে থাকছি তুমি একটু ছায়াতে যাও। কে শোনে কার কথা। ঠাই দাঁড়িয়ে ছিলো রোদের মধ্যে..! এমন করার কারণ কি? শুনতেই, জবাব মিলেছিল ‘দিনের পর দিন এমন রোদ্দুরে দাড়িয়ে থাকার অভ্যাস আছে,এতটুকু সহ্য করতে পারছো না,পড়বো না তাই MCSK’তে !’ একবার প্রচন্ড জ্বরে ভর্তি ছিলো,প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সাপ্তাহিক ফোন কলে শুধু বলেছিলো ‘জ্বর,কয়দিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে যাও, সুস্থ হয়ে যাব’ সামরিক বাহিনী পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সামান্য জ্বর এর জন্য ছুটি! যা ছিল অসম্ভব কিন্তু…! এমন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে বড় বেটার বোডিং শিক্ষা জীবন! যা লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে, সেই দিকে না যায়!
কলকাতার ভিক্টোরিয়া পার্কের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে পুত্র হঠাৎ বিরক্ত ও ক্লান্ত ! বুঝতে একটু বিলম্ব হয়েছিল,ছেলে আমায় প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত কিন্তু মুখ ফুটে বলবে না,অনুভবে বুঝে নিতে হবে! দ্রুত বাইরে এসে,কাছেই হোটেল তাই যাবার কোন যানবাহন পেলুম না ! অগত্যা, বেশ খানিকটা পথ হাটার পর চোখ গেলো,ফুটপাতের পাশে গরম গরম বাঙালি খাবারের দিকে কিন্তু মানুষ ও ব্যক্তিগত গাড়ির বিশাল লাইন। ক্ষুধার যন্ত্রণায় সন্তান দিশাহারা। মালিকের কাছে যেতেই মিলে গেলো,তিনি আদি যশোরের মানুষ। বিশেষ ব্যবস্থা করে দিলেন,সেই খাবারের স্বাদ কোনদিন ভুলবো না।
দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঙ্খিত বিষয়ে ভর্তির জন্য সারাদিন ধ্যানে মগ্ন। IUT’তে মোটামুটি ভালো পজিশনে ছিল কিন্তু বাপ বেটা মিলে সিদ্ধান্ত,যেহেতু টার্গেট একটি বিষয় তাই,একটি সাবজেক্ট তাও স্কলারশিপ,এমন আবেদন শুধুমাত্র একটি ছাত্রই করেছিলো ! ফলাফল, ২য় তালিকা থেকে ছিটকে যায়, বিগত বছর গুলোর ট্র্যাক রেকর্ড চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্তটা আমরা নিয়েছিলাম। তবু নানা জনের নানা কথা শুনে হয়েছিলাম, কনফিউজড ! সেই সময় দেশের বাইরের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর জন্যও প্রস্তুতি নিতে বলেছিলাম,আপত্তি থাকলেও গতানুগতিক ভাবে কাজটি করেছিলো, একটা সুবিধা তাকে একটি কথা দুইবার বলতে হয় না। পরে অবশ্য ঐ সুবিধা দিয়েই IUT ডেকেছিল কিন্তু…! বুয়েটের ফল প্রকাশের পর বলেছিল, ‘সেই সময় অন্যদিকে মনোনিবেশ না করতে হলে আরো ভালো করতাম’! এখন অবশ্য তার স্বাক্ষর রেখে চলছে…
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কিন্তু পিতার কাছে, শিশুতোষ মনোভাব একটুও বদলায়নি ! বাবা-মার কাছে সন্তান কোন সময় মনে হয় বড় হয় না,সন্তানদেরও মনে হয়,একই অনুভূতি থাকে। তাই বোধহয়,এখনোও খোটা দেয় ‘ছেলেকে ক্যাডেটে দিয়ে,জীবনের সৃজনশীলতা নষ্ট করেছো’! সেই নিঠুর বাস্তবতায় বাবা হিসাবে অন্য কোন বিকল্প পথ কি খোলা ছিল ! জানিনা কোনদিন বুঝবে কিনা,জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কোন গুলো ছিলো..! আগামী দিনের কম্পিউটার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের জীবন,এখন 0 আর 1’এর হিসাব-নিকাশের মধ্যে ডুবে থাকে। পিতা অবশ্য এর মধ্যে কোন সৃজনশীলতা খুঁজে পায় না ! মনে করে, কাঠখোট্টা কিছু। কিন্তু ছেলেটি দিনরাত ওই যন্ত্রের মধ্যে কি সৃজনশীলতা খুঁজে ফেরে,তা কে জানে ! যখন যেটা নিয়ে মাতে তা অতি বাড়াবাড়ির পর্যায় চলে যায়। মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্যের খুব একটা পরিবর্তন হয় না। তাই বুঝে না বুঝেই হয়তো মাতৃস্নহ বলে, ‘চোখের বারোটা বাজবে,একটু বিরতি নাও’ তখন সন্তান হয় ,কনফিউজড ! এটাই সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের জীবন।
এখন হুটহাট করে পরিচিত অপরিচিত জনেরা না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে। তাই একদিন কথা প্রসঙ্গে মৃত্যুর কথা বলতেই,গাণিতিক হিসাব কষে, শিশুর মতোই কথা ‘দাদুর বয়স একশোর কাছে,তোমার দাদাও বেঁচে ছিলেন শত বছর, তাদের উত্তরসূরী হয়ে এই অল্প বয়সে..! কট্টর বিজ্ঞানমনস্ক ও নামাজী ছেলের এমন অনেক যুক্তি বাবা হিসাবে মনে মনে হাসায়। আবার,সম্পর্কে ভিন্নতায় তার চিন্তা-কথা ও কাজের ভিন্ন রূপ বিরাজমান ! যা দেখে-শুনে, পিতাও হয়,কনফিউজড ! দাদাকে দেখেছিলাম,বাবাকেউ দেখছি শেষ বয়সে মানুষ শিশুর মতোই হয়ে যায়। জীবন চক্র, এই ভাবেই হয়তো ঘুরে ফিরে আসে! প্রচন্ড রাগি-একগুঁয়ে-স্বাধিনচেতা,দাদার শরীরটাও ছিলো চিতার মতই, সেই দাদা শিশুতোষ হয়ে যায়। তখন অনেক কিছুই শিখেছি,এখনও বাবার কাছ থেকে শিখি । মানুষ যেমনই হোক,প্রায় সবাই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, ভালো ও পবিত্র রুপেই থাকতে চায়। সন্তানদেরও আদর্শিক গুণে দেখতে চায়।
নবীন ও প্রবীণের এই ইতিবাচক দ্বন্দ্ব,উভয়ের জ্ঞান বিকাশে অনেকটা টনিকের মতই কাজ করে। স্পর্শকাতর এই সম্পর্ক কিছু সময়,কোনটি সঠিক আর কোনটি বেঠিক তার সমাধানের জন্য ভবিষ্যতে ফলাফল দেখার অপেক্ষায় ছেড়ে দিতে হয় ।
সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের,সন্তানের সাথে একই সাথে দুটি বিপরিত চরিত্রের ভূমিকা পালন করতে হয়। তাই, ভালোবাসা-স্নেহ-মমতা, একইসাথে শিক্ষক-পথপ্রদর্শক-পরামর্শক-নির্দেশক কখনো সখনো প্রশাসকের সমন্বয় ঘটিয়ে,স্বাধীন দৃঢ়চেতা সন্তানদের সাথে সব বিষয়ে মন জুগিয়ে চলা কঠিন। বিশ্বাস আস্থা ও প্রেম ছাড়া সম্ভব নয়। বিপত্নীক মানুষের পক্ষে সন্তানকে মাতৃস্নেহ দেওয়া,আসলেই দূরূহ ! চেষ্টা করলে হয়তো একজন ভালো পিতা বা মাতা হওয়া যায় কিন্তু একসাথে টু ইন ওয়ান হওয়া কি সম্ভব ! এটাই হয়তো,সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের সীমাবদ্ধতা ও তাদের সন্তানদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা, ভুক্তভোগীরা ছাড়া কেউ তা বুঝবে না।