ঝিনাইদহের চোখ-
বেশ আগে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। সেই টাকা এখনো শোধ করতে পারেননি। এরই মাঝে ব্যাংক থেকে ফোন করে জানানো হয়েছে নতুন ৫৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। অথচ তিনি নতুন কোন ঋণ নেননি। আগের ঋণের কাগজপত্র দেখিয়ে এই ৫৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে আজির আলী নামে ব্যাংকের এক কর্মচারী। কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার আড়পাড়া এলাকার কনিকা অধিকারী।
এভাবে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাহকের কাগজপত্র তৈরি করে ও মৃত ব্যক্তিদের নামে ঋণ নবায়ন করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ ঘটনায় ৩ সদস্যের একটি অডিট টিম ঋণের অনিয়ম খুঁজতে কাজ করছে।
বিষয়টির অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভ‚য়া ঋণের প্রায় ১০ জন গ্রাহকের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা সবাই নতুন কোন ঋণ নেননি বলে জানান। হঠাৎ তারা ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে ফোন পেয়ে ব্যাংকে যোগাযোগ করেন।
অগ্রণী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখার বর্তমান ম্যানেজার নাজমুস সাদাত বলেন, তিনি এ শাখায় যোগদান করার পর কৃষিঋণ দেওয়ার ব্যাপারে অসঙ্গতি খুঁজে পান। মৃত ব্যক্তিদের নামে ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ভ‚য়া গ্রাহক ও টাকার সংখ্যা বাড়ছে। ঠিক এই মুহুর্তে কতজন গ্রাহক ও টাকার পরিমাণ কত হতে পারে এমন কিছু বলা ঠিক হবে না। বিষয়টি তদন্তনাধীন। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কতজন গ্রাহক ও টাকার পরিমাণ বলা যাচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে গ্রাহকদের কাগজপত্র জাল করে ৪% সুদে কৃষিঋণের টাকা নিজেরা আত্মসাৎ করে। গ্রাহকেরা নিজেরাই জানেন না তাদের নামে এসব ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর সাথে জড়িত অগ্রণী ব্যাংকের কালীগঞ্জ শাখার তৎকালীন মাঠ সহকারী আজির আলী, ক্রেডিট অফিসার আব্দুস সালাম। এরা দু’জন স্থানীয় প্রভাবশালীদের দিয়ে ব্যাংকের ম্যানেজার শৈলেন কুমার বিশ^াসকে দিয়ে স্বাক্ষর করে এই ঋণের টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন। আজির আলী ভ‚য়া গ্রাহকদের ঋণের সুপারিশকারী। এছাড়াও উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের আব্দুল মালেক মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ৩ বছর আগে কিন্তু তার নামেও ৪৮ হাজার ও পুকুরিয়া গ্রামের হোসেন আলী মারা যান ২ বছর পরও ৪৭ হাজার টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়। এসব বিষয় জানাজানি হলে গত ১৩ সেপ্টেম্বর মাঠ সহকারী আজির আলীকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে ঝিনাইদহ সদর হামদহ বাসস্ট্যান্ড শাখায় বদলি করা হয়। এছাড়াও ব্যাংকের ম্যানেজার শৈলেন কুমারকে ওএসডি করে চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক অফিসে বদলি করা হয়। এরপর থেকেই ব্যাংকটিতে ভ‚য়া গ্রাহক ও টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি কাজ করছেন।
ব্যাংক সুত্রে জানা গেছে, খুব গোপনে এসব অসঙ্গতির বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে তদন্ত কমিটি। গত এক মাস যাবৎ প্রতিদিন দুইজন কর্মকর্তা ভ‚য়া ঋণের খোঁজে কাজ করছেন। মাঠ সহকারী আজির আলী ও ক্যাশ অফিসার আব্দুস সালাম বিষয়টি ধামাচাঁপা দিতে ক্ষমতাসীনদের ব্যবহারের চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি টাকার বেশি ভ‚য়া ঋণের খোঁজ পাওয়া গেছে। তদন্ত টিমের সদস্যরা প্রতিদিনই নতুন নতুন গ্রাহকের সন্ধান পাচ্ছেন। তাদের সাথে ফোনে কথা বলে ব্যাংক ঋণের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন।
উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম জানান, এক সপ্তাহ আগে কালীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৩/৪ জন লোক আসছিল। তারা বলে আমার স্বামী নাকি ৬ মাস আগে ব্যাংক থেকে ৪৮ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু আমার স্বামী প্রায় ৩ বছর আগে মারা গেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা বলেন, ক্রেডিট অফিসার আব্দুস সালাম ও মাঠ সহকারী আজির আলী রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকের ম্যানেজার শৈলেন কুমার বিশ^াসকে দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে এসব টাকা আত্মসাৎ করেন। এসব টাকা আত্মসাৎ করে তারা বিপুল অর্থের মালিক হয়ে গেছেন। প্রায় ২ কোটি টাকা তখনকার ম্যানেজার শৈলেন কুমার বিশ^াস, ক্রেডিট অফিসার আব্দুস সালাম ও মাঠ সহকারী আজির আলী আত্মসাৎ করেছেন। ব্যাংকের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে দুর্ব্যবহার করতেন তারা দু’জন।
অভিযুক্ত ব্যাংকটির তখনকার মাঠ সহকারী আজির আলী বলেন, ব্যাংকের সকল ঋণের বিষয়ে একজন ম্যানেজার সবকিছু জানেন। ম্যানেজারের বাইরে কিছু করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তার স্বাক্ষর ছাড়া কোন ঋণ পাশ হয় না। গত ১৩ সেপ্টেম্বর চিঠি হাতে পাই। ১৪ তারিখে ঝিনাইদহ হামদহ বাসস্ট্যান্ড শাখায় যোগদান করতে বলা হয়। এটা স্ট্যান্ড রিলিজ না। আমি জেনেছি অগ্রণী ব্যাংকে অডিট চলছে। এছাড়া আমি কোন টাকা আত্মসাৎ করিনি বলেও দাবি করেন।
ক্রেডিট অফিসার আব্দুস সালাম বলেন, কিছু অসঙ্গতি আছে। একটা ঋণের বিষয়ে ব্যাংকের ম্যানেজার সবকিছু জানেন। তার স্বাক্ষর ছাড়া কেউ টাকা উত্তোলন করতে পারেন না।
ব্যাংকটির তখনকার ম্যানেজার শৈলেন কুমার বিশ^াস বলেন, মাঠ সহকারী আজির আলী ও ক্রেডিট অফিসার আব্দুস সালাম এ ঘটনায় জড়িত। আমি পলিটিক্যাল ভিকটিম হয়েছি। ওরা দু’জন সব কিছু ম্যানেজ করেছে। আমি কিছু জানিনা, ওরা সবকিছু জানেন। আজির আলী সব ঋণের সুপারিশকারী। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মৃত ব্যক্তিদের নামে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে তিনি তেমন কিছু জানেন না। শুনেছি তদন্ত চলছে। এখনো তদন্তের রিপোর্ট হাতে পাইনি।
অগ্রণী ব্যাংকের ঝিনাইদহ আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডিজিএম (উপব্যবস্থাপক) দীন মোহাম্মদ বলেন, আমরাও এমন আভাস পেয়ে তদন্তে নেমেছি। তদন্ত চলছে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত টাকার পরিমাণ বলা যাচ্ছে না। আপনারা যে ঘটনা শুনেছেন সেটা সঠিক।