কালীগঞ্জজানা-অজানাটপ লিডদেখা-অদেখা

ঝিনাইদহে আরো এক ক্ষুদে আবিষ্কারকের সন্ধান লাভ

ঝিনাইদহের চোখ-
পরিত্যক্ত কার্টন, মোবাইল চার্জার ও কোমল পানীয় বোতলের চারটি মুটকি দিয়ে তৈরি রিমোট কন্ট্রোল খেলনা মাইক্রোবাস বড় ঘিঘাটি গ্রামের রাস্তায় চালাচ্ছিল এক শিশু। শিশুটিকে খালি পায়ে, অপরিষ্কার হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি গায়ে এ খেলনা চলাতে দেখা যায়। ১১ বছর বয়সী ওই বালক নিজেই তৈরি করেছে সেটি। খেলনা মাইক্রোটিবাসটি চালানো দেখে তাকে ডাক দিতেই সে থমকে দাঁড়ালো।

হ্যাঁ, ওই শিশুটি ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের বড় ঘিঘাটি গ্রামের মৃত লালটু বিশ্বাস ও রিনা খাতুনের ছেলে শাহরিয়ার নাফিজ। সে বড় ঘিঘাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে এখন সুন্দরপুর এসসিএ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।

খুদে আবিষ্কারক নাফিজ জানায়, ইলেকট্রনিক যে কোনো জিনিস তৈরির প্রতি বছর দেড়েক আগে থেকে আমার প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। মূলত: আমাদের প্রতিবেশী বড়ভাই তামিমের একটি ইলেকট্রনিকের দোকান আছে স্থানীয় বাজারে। আমি প্রায় সেখানে গিয়ে তামিম ভাইয়ের ইলেকট্রনিকসের কাজ কিভাবে করেন, কোন পার্টসের কী নাম, কোনটির কী কাজ এসব দেখতাম ও জানতাম। হঠাৎ মাথায় আসল একটি ছোটো ডামট্রাক বানাবো।

তারপর পুরনো কার্টন, অব্যবহৃত সিরিঞ্জ, স্যালাইনের প্লাস্টিকের সরু পাইপ, কোমল পানীয় সেভেন আপের বোতলের বাতিল চারটি মুখ, পলিথিন, মোবাইল ফোনের পুরনো ব্যাটারি ও চার্জের জন্যে সকেট জোগাড় করে ছোটো একটি ডামট্রাক বানিয়ে ফেললাম। আমার বানানো প্রথম গাড়িটি যখন আমি বাড়ির উঠানের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে চালাচ্ছিলাম তখন আমার মনের মধ্যে অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করছিল।গল্পের ছলে যখন খুদে এই আবিষ্কারক তার প্রথম আবিষ্কারের গল্প এই প্রতিবেদকে শোনাচ্ছিল তখন তার চোখেমুখে উদ্ভাবনী আবিষ্কারের অন্যরকম এক উচ্ছলতা ফুটে খেলে যায়। ডামট্রাক বানানো শেষে নাফিজ শুরু করে রিমোট কন্ট্রোল মিনি মাইক্রোবাস বানানোর কাজ।ডামট্রাক বানানোর উপকরণে সে এটি তৈরিতে ও ব্যবহার করে। বাড়ির ব্যবহৃত প্লাস্টিকের টিফিনবক্স ও ছোট ব্লেড ব্যবহার করে নাফিজ তৈরি করেছে একটি ব্লেন্ডার। তার তৈরি ব্লেন্ডারটিতে ছোট ছোট সবজি অনায়াসে কেটে যাচ্ছে।এছাড়াও সে সেভেন আপের দুইটি মুখ , ছোট মোটর ও পাইপের সাহায্যে তৈরি করেছে পানিরপাম্প। যে পাম্পের সাহায্যে পানি একপাত্র থেকে অন্যত্র উত্তোলন করা সম্ভব। খুদে এই আবিষ্কারকের ছোট ছোট আবিষ্কারগুলো নিয়ে তার গ্রাম, পাড়া ও মহল্লায় রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেছে। কোনো প্রকার সাহায্য- সহযোগিতা ছাড়া নিজবুদ্ধি-জ্ঞানে নাফিজের এই আবিষ্কারগুলো সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে বলে অনেকেই মনে করেন।

এ ব্যাপারে নাফিজের মা রিনা খাতুনের সাথে কথা বলে জানা যায়, নাফিজের বাবা স্ট্রোকজনিত কারণে যখন মারা যান তখন নফিজ প্রাইমারি স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়তো। স্বামী একটি মেয়ে ও একটি ছেলে নিয়ে আমার সুখের সংসার ছিল। হঠাৎ করে নাফিজের বাবা মারা যাওয়ায় সংসারে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। তখন আমি বছর খানেকের জন্যে আমার বাবার বাড়ি তিল্লা গ্রামে বসবাস করতাম। পরবর্তীতে ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি বড়ঘিঘাঁটিতে ফিরে আসি। তার কিছুদিন পর থেকেই লক্ষ করি আমার ছেলে অব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে ছোট ছোট গাড়ি, ব্লেন্ডার ও পানি তোলা পাম্প তৈরি করে। প্রথমে আমি তার কাজে বাধা দিলে সে তা শুনতো না।এইসব কিছু বানানোর প্রতি তার ছিল প্রবল আগ্রহ। ছেলের এই মেধা দেখে মনের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়,তাকে লেখাপড়া পড়া শেখাবো,একদিন সে দেশসেরা ইঞ্জিনিয়ার হবে।

নাফিজের মা ছেলের স্বপ্নময় ভবিষ্যতের কথাগুলো বলতে বলতেই তার কণ্ঠস্বরে যেনো একরাশ হতাশা স্পর্শ করলো। লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, নাফিজের লেখাপড়া ঠিকঠাকভাবে চালিয়ে নেয়ার মতো আর্থিক সামর্থ আমার নেই।বড় মেয়েটা দশম শ্রেণিতে পড়ে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ওর বাবার মৃত্যুতে আমার একার পক্ষে সংসার চালানো হয়ে পড়েছে কঠিন ব্যাপার। তার ওপর আবার লেখাপড়ার এই বাড়তি খরচ। এরকম একটা পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানমনস্ক মেধা আমার ছেলের থাকলেও আমি তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত। সমাজের বিত্তবান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ যদি আমার ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারে সহযোগিতা করেন তাহলে হয়তোবা সে একদিন প্রকৌশলী হয়ে দেশ ও দশের সেবা করতে পারবে বলে আমি মনে করি।

নাফিজের চাচা আনিসুর রহমান টোটন বলেন, আমার বাপহারা এতিম ভাতিজার এ বয়সে অন্যদিকে মন না দিয়ে ইলেকট্রিক তথা বৈজ্ঞানিক ছোটখাটো জিনিস তৈরির প্রতি যে আগ্রহ আমি লক্ষ করেছি তা সত্যিই অনেক আনন্দের। মহান আল্লাহতালা তাকে যে মেধা দান করেছেন তার যথাযথ চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা যদি করা হয় তাহলে সে নিশ্চয়ই একদিন বড় কিছু করতে পারবে। তাই আমি চাই সমাজের শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ যদি এতিম এই শিশুর পড়ালেখার ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে সে পড়ালেখা করে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।

খুদে আবিষ্কারক ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া শাহারিয়ার নাফিজ এই প্রতিবেদককে জানায়, আমি লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে গাড়ি, বিমান ও হেলিকপ্টার বানাতে চাই। আমি যা যা বানিয়েছি সেগুলো তো এখন শুধু খেলনা। খেলা ছাড়া এগুলো আসলে কোনো কাজে আসে না। কিন্তু আমি চাই আমি যে গাড়ি বানাবো তা রাস্তায় চলবে, মানুষ চড়বে। যে বিমান ও হেলিকপ্টার তৈরি করব তা আকাশে উড়বে। আর এটা আমার স্বপ্ন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button