পাঠকের কথা

গৃহবন্দি আজ দুরন্ত শৈশব—-এম এ কবীর (সাংবাদিক)

ঝিনাইদহের চোখঃ

চায়ের আড্ডা, অফিসের আড্ডা, স্কুল-কলেজের আড্ডা, বিভিন্ন বয়সী বন্ধুদের আড্ডা, কপোত-কপোতির আড্ডা, মালিকের আড্ডা, শ্রমিকদের আড্ডা, পথশিশুদের আড্ডা, ভাবিদের আড্ডা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আড্ডা, ড্রাইভার-হেলপারদের আড্ডা, বুয়াদের আড্ডা,বয়স্কদের আড্ডা, ভিক্ষুকদের আড্ডা, এরকম আরো শত ধরনের আড্ডা বিগত বেশ কিছু দিন হয়নি ।

আমাদের জাতীয় কবি
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর
‘ধূমকেতু’ কবিতায় লিখেছেন —

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
সাত সাতশো নরক-জ্বালা জলে মম ললাটে,
মম ধূম-কুন্ডলী করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘোলাটে।
আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ,
আমি ¯্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার
আর মর্তে সাহারা-গোবি-ছাপ,
আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ!
আমি সর্বনাশের ঝান্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূন্যে,
আমি বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান-অভিমুন্যে।
শোঁও শন-নন-নন-শন-নন-নন শাঁই শাঁই,
ঘুরপাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই
মম পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি;
করি উল্কা-অশনি-বৃষ্টি,
আমি একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি।
আমি অপঘাত দুর্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!
আমি আপনার বিষ-জ্বালা-মদ-পিয়া মোচড় খাইয়া খাইয়া
জোর বুঁদ হয়ে আমি চলেছি ধাইয়া ভাইয়া!
শুনি মম বিষাক্ত ‘রিরিরিরি’-নাদ
শোনায় দ্বিরেফ-গুঞ্জন সম বিশ্ব-ঘোরার প্রণব-নিনাদ!
ধূর্জটি-শিখ করাল পুচ্ছে
দশ অবতারে বেঁধে ঝ্যাঁটা করে ঘুরাই উচ্চে, ঘুরাই
আমি অগ্নি-কেতন উড়াই!
আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

এ এক ক্রান্তিকাল। করোনাসৃষ্ট দুর্যোগে ভালো নেই কেউ। প্রকৃতির নিয়ম সবই ঠিক আছে- সূর্য উঠছে, ডুবছে। নদীতে বইছে স্রোতধারা। জোয়ারের জল গড়াচ্ছে তীব্রস্রোতে। নিয়ম ভেঙেছে শুধু জনজীবনের ধারাবাহিকতায়। এর প্রভাব পড়েছে শিশুদের জীবনেও। গৃহবন্দি আজ দুরন্ত শৈশব। নিষেধের বেড়াজালে এসেছে দারুন দুঃসময়। পাল্টে গেছে শিশুর দৈনন্দিন জীবন। প্রভাব পড়ছে শিক্ষায়, চাপ বেড়েছে মননে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন —

অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে। নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর কর হে। জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে। মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে। অন্তর মম বিকশিত করো, অন্তরতর হে। যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ, সঞ্চার করো সকল মর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।
নীরবতা, অকল্পনীয় দৃশ্যপট! সবখানে বারণ। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না- দিনভর বড়দের মুখে শুনতে হয় হাজারটা নিষেধ-বাক্য। বিকেলের খেলার মাঠে বন্ধুদের ভিড় নেই। চায়ের দোকানে সিনেমা দেখার আড্ডা নেই। গোধূলি বেলায় ছোটাছুটি নেই। খেলাধুলা সব ঘরে ; কিংবা ঘরের আশপাশে। তাই সান্ধ্যকালীন মায়ের গলায় ডাকও নেই। পরের দিনে ক্লাসের জন্য হোমওয়ার্কের ব্যস্ততা নেই। কেমন যেন গুমোট ভাব।

চারদিকে আতঙ্ক! ঘরের বাইরে খুব একটা যাওয়ার সুযোগ নেই, প্রয়োজনও নেই। ক্ষুদে জীবনে এমন নিষেধাজ্ঞায় তারা কখনো পড়েনি। শৈশবের দুরন্তপনায় হঠাৎই যেন ছেদ পড়েছে। কেউ কখনো ভাবেনি শিশুদের এভাবে ঘরবন্দি থাকতে হবে। ওরা ভাবতেই পারে না, ক্লাসের ফাঁকে সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠার সময়টা কোথায় হারিয়ে গেল ? শহর ছাড়িয়ে বন্দিদশার এই ঢেউ এসে পৌঁছেছে প্রান্তিকেও।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ভাষায় —
কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই- দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই। পুরনো আবাস ছেড়ে যাই যবে মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে, নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন সে কথা যে ভুলে যাই। দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই। জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে যখনি যেখানে লবে, …

দুরন্তপনায় ছেদ পড়েছে। খাল পেরিয়ে, কাদাপানি মাড়িয়ে, স্কুলে যাওয়া তার মাঝেও যে কত আনন্দ; কাউকে বোঝাতে পারে না। পড়ায় মন নেই। শৈশবের এক অবরুদ্ধ জীবন; যা কেউ কখনো কল্পনাই করেনি।, স্কুল, খেলার মাঠ, নদীর তীরের কথা খুব মনে পড়ে। সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা নেই অনেকদিন। ওদের কথা মনে পড়ে বার বার।

সুকুমার বড়ুয়া লিখেছেন —

এমন যদি হতো –
ইচ্ছে হলে আমি হতাম
প্রজাপতির মতো
নানান রঙের ফুলের পরে
বসে যেতাম চুপটি করে
খেয়াল মতো নানান ফুলের
সুবাস নিতাম কতো ।
এমন হতো যদি
পাখি হয়ে পেরিয়ে যেতাম
কত পাহাড় নদী
দেশ বিদেশের অবাক ছবি
এক পলকের দেখে সবই
সাতটি সাগর পাড়ি দিতাম
উড়ে নিরবধি ।

শুধু কী স্কুল! ক্লাসের ফাঁকে। জীবনের কত গল্প। বন্ধুর সঙ্গে গলাগলি করে হাটে যাওয়া। মাঠে ঘুরে বেড়ানো। খেলাধুলা। ঘোলা জলে ডুবসাঁতারের আনন্দ। জীবনকে আরো রাঙিয়ে দেয়।
স্কুলে না যাওয়া শিশুও হাজারটা রঙিন স্বপ্নে বিভোর থাকে।

একজন হয়তো স্কুল ছুটি হলে ঘুড়ি উড়াতে ছুটে যায় মাঠের পানে। আরেকজন জালনৌকা গুছিয়ে চা-দোকানে ছোট্ট টিভি পর্দায় অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। প্রান্তিকের এই শিশুরা অন্যরকম এক জগতে বেড়ে ওঠে। এখানে আছে জীবনের সঙ্গে লড়াই, সংগ্রাম। আছে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ।
কাদামাটিতে পথ চলা, খেলাধুলা, জোয়ারের জলে ভিজে এ-পাড়া থেকে ও-পাড়ায় যাওয়া। চা-দোকানে রঙিন সিনেমার গল্পের সঙ্গে ওদের জীবনের কোনো অংশেরই হয়তো মিল নেই। তা সত্তে¡ও সাময়িক ওরা স্বপ্নে বিভোর থাকে। রঙিন প্রজাপতির ওড়াউড়ি। দোয়েল পাখির গান। বাতাসে টকটকে রাঙা জবা ফুলের দোল খাওয়া। সবুজ খোলা মাঠে রাখালের গরু চরানো। কিন্তু এখন থমকে যাওয়া জীবন! করোনা সবকিছু বদলে দিয়েছে।

জাতীয় কবিও স্বপ্ন দেখেছেন,
লিখেছেন–
আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।
সূয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’- মা বলবেন রেগে।
বলব আমি, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল- তাই বলে কি সকাল হবে না ক ?
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’

করোনার, স্কুল বন্ধ, ঘরের বাইরেও খুব একটা যেতে পারে না। ভীতি আছে পরিবারে। সহপাঠীদেরও একই অবস্থা। ঘর থেকে নিষেধাজ্ঞা বেড়েছে। বাবা-মায়েরা কড়াকড়ি বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনা বদলে দিয়েছে এভাবেই।

যে শিশুরা বাইরে কাজ করতো; তাদেরও চলাফেরা বন্ধ। রোজ বিকালে শিশু-কিশোরদের এখন আর বাজারের আড্ডায় যাওয়া হয় না।

মেঠো পথে ডাংগুলি খেলা, মার্বেল খেলা, বৌচি খেলায় মেতে ওঠে না শিশুরা। এখন আর সাইকেলের পুরনো টায়ার নিয়ে দীর্ঘ পথে দৌড়ানো হয় না ওদের। রঙিন শৈশবটা এখন শুধুই সাদাকালো।
শহরের মতো অতটা আবদ্ধ হয়তো নয় ওরা; কিন্তু একটা আতঙ্ক তো রয়েছেই। আমরা সকলকে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকতে বলেছি। ‘অবাধে উড়ে বেড়ানো পাখিকে হঠাৎ খাঁচায় বন্দি করলে যে দশা হয়; শিশুদের অবস্থা এখন অনেকটা সেরকম। এটা তো ওদের পরিবেশ নয়।’

রঙিন স্বপ্নের ডানায় ভর করে বেড়ে ওঠা শিশুদের পায়ে যেন হঠাৎই শেকল পড়েছে। বদ্ধ ঘরে বসে কারো মনে পড়ে বটতলার সেই বড় শেকড় দুটোর কথা! কারও-বা মনে পড়ে কাচারি বাড়ির সান বাঁধানো পুকুর ঘাটের কথা! কবে স্কুল খুলবে? কবে বন্ধুদের সঙ্গে আবার আড্ডা হবে? কবে কাটবে দুঃসময়? তবেই না মুক্তি পাবে শৈশব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button