কোটচাঁদপুরটপ লিড

মায়ের চোখের মনি ঝিনাইদহের আরাফাত সব শ্রেনিতে প্রথম

ঝিনাইদহ চোখ-

জন্ম থেকেই দুই হাত নেই ১১ বছর বয়সী শিশু আরাফাতের। তাতেও দমে যায়নি সে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই প্রবল আগ্রহের কারণে স্কুলে ভর্তি করতে একপ্রকার বাধ্য হয় তার পরিবার। কনুই দিয়ে লিখেই প্রাথমিকের লেখাপড়া শেষ করে এবার মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে। শুধু তাই নয়! প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব ক্লাসে প্রথম হয়েছে আরাফাত। প্রথমিকের সমাপণি পরীক্ষায় পেয়েছেন জিপিএ ৫।

বলছিলাম, অদম্য মেধাবী ছাত্র আরাফাত মল্লিকের কথা। ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার বলুহর গ্রামের আল আমিন মল্লিক ও সেলিনা দম্পির দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে আরাফাত। দক্ষিণ বলুহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের লেখাপড়া শেষ করেছে। বর্তমানে কোটচাঁদপুর সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ক শাখার ছাত্র। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ১৮০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিবন্ধি কোটায় ভর্তি হন আরাফাত। সহপঠিদের সহযোগীতাসহ বিদ্যালয়ের সুযোগসুবিধাও পাচ্ছেন।

সরোজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আরাফাত সকালে পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে। হাত না থাকায় কনুই দিয়েই লিখছে। একা একাই গোসল করছে, কিন্তু কাপড় পড়তে মায়ের সহযোগীতা নিতে হচ্ছে তাকে। খাবার খেতে তেমন সহযোগীতা প্রয়োজন না হলেও হাতের কুনই দিয়েই কষ্টকরে ভাত খেতে হচ্ছে। একা একাই স্কুলে আসা যাওয়া করে। ক্লাসেও অন্য শিক্ষাথীদের মত স্বাভাবিক ভাবে বোর্ডে লিখতেও পারছে।

আরাফাতের মা সেলিনা খাতুন বলেন, আরাফাত আমাদের প্রথম সন্তান। যখন জন্মগ্রহণ করে তখন ওর এমন অবস্থা দেখে খুবই হতাশ এবং মর্মহত হই। তখন আমি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ি, তাকে মানুষ করা নিয়ে নানা চিন্তা করতে থাকি। এরপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক ভাবে ওর পরিচর্যা করে বড় করতে থাকি। কিন্তু অন্য সাধারণ বাচ্চাদের মত স্বাভাবিক কাজকাম করতে পারেনা। খেলাধুলাসহ অন্যকোন কাজ করতে পারে না। ওর মাঝে আমি লেখাপড়ার আগ্রহ দেখতে পাই, তারপর স্কুলে ভর্তিকরি। স্কুলের শিক্ষকরাও ওকে আগ্রহ করে স্কুলে ভর্তি নেই। শিক্ষকরাও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়, ছেলেটিও অনেক আগ্রহ ভরে লেখাপড়া করতে থাকে।

তিনি আরো বলেন, এবার প্রাথমিকের সমাপণি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার পর বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। বৃত্তি পরীক্ষায় আরাফাতের মেধা তালিকায় বৃত্তি পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু সে বৃত্তি না পাওয়ায় স্কুলের শিক্ষক ও আমাদের সবার খারাপ লেগেছে। আমাদের সন্তান উচ্চু শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, সরকারি বড় অফিসার হবে। মানুষের মত মানুষ হয়ে দেশের সেবা করবে এটাই আমাদের আশা।

আরাফাতের বাবা আল আমিন মল্লিক বলেন, জন্ম থেকেই আরাফাতের দুই হাতের কনুইয়ের নিচের অংশ নেই। আঙুল না থাকায় স্বাভাবিকভাবে কোনো কিছু ধরতে পারত না। তবে কনুই দিয়ে লিখে প্রাথমিকের পড়া শেষ করে এবার মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে। প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো ক্লাসে সে দ্বিতীয় হয়নি। তাকে নিয়ে অনেক আশা আছে। সহপাঠিদের ও শিক্ষদের সহযোগীতা ওর জন্য খুবই প্রয়োজন।

৬ ষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষকা রেহেনা পারভিন জানান, আরাফাতকে দেখে প্রথমে অনেক খারাপ লেগেছিল। পরে ওর অনুভুতি লেখাপড়ার আগ্রহ ইচ্ছা দেখে খুব ভালো লেগেছে। সে নিয়মিত স্কুলে আসে। প্রতিদিন ক্লাসের পড়া অন্যদের থেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করে বা পড়া দেয়।

আরাফতের সহপাঠিরা জানান, আরাফাত নিজেই নিজের কাজ করতে পারে। পড়ালেখার প্রতি ওর অনেক আগ্রহ। ছাত্র হিসাবে সে অনেক ভালো । কখনই স্কুলের ক্লাস বাদ দেই না। টিফিনে খাবার সময় বন্ধুরা সবাই সহযোহিতা করে। তবে ও কারো সহযোগিতা নিতে চায় না। পড়ার প্রতি তার ব্যাপক আগ্রহ। সবাই সহযোগিতা করলে সে অনেক ভালো কিছু করবে।

মেধাবী আরাফাত মল্লিক জানায়, সে নিজের কাজ গুলো দুই হাতের কুনই দিয়েই করে। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানো, হাতের লেখা, খাতাই অংখ করা, গোসল করা, খাবার খাওয়া সবাই নিজে নিজে করে। তবে মাঝে মাঝে স্কুলে দেরি হয়ে গেলে মা-বাবার সহযোগিতা নেই, তাদের উপর নির্ভশীল হতে হয়। স্কুলে অন্য বন্ধুদের মতো লিখতে গেলে একটু সমস্য হয়। অন্যদের মতো দ্রæত লিখতে পারেনা।

সে আরো জানায়, এবার প্রাথমিকে আমার মেধাতালিকায় বৃত্তি পাওয়ার কথা ছিলো। বৃত্তি পরীক্ষায় ৬০মার্কের প্রশ্ন ছিলো, তার মধ্যে ৫৫টি টিক মার্কের উত্তর দিতে পেরেছি। বাকি ৪০ মার্কের লিখিত প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে দিয়েছি, কিন্তু আমি বৃত্তি পাইনি। সেটা আমার খুবই খারাপ লাগে।

ইচ্ছার কথা জানতে চাইলে আরাফাত বলে, পড়াশুনা শেষ করে সরকারি বড় অফিসার (ম্যাজিস্ট্রেট) হতে চাই। দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে চাই। তার মতো প্রতিবন্ধিদের পাশে দাড়াতে চাই।

কোটচাঁদপুর সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মফিজুর রহমান বলেন, আরাফাত পুরো স্কুলের ব্যতিক্রমী একজন মেধাবী ছাত্র। এবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। তার চেষ্টা সবাইকে অবাক করে। স্বাভাবিক ভাবে যেন সে বেড়ে উঠতে পারে তার জন্য সকল শিক্ষক ও তার সহপাঠিদের সকর্তকরা আছে। এছাড়াও তার জন্য বিশেষ দুইটি উপবৃত্তির প্রস্তাব করা হয়েছে তার। তার লেখাপড়ার জন্য সকল ধরনের সুযোগসুবিধা আমাদের স্কুলের পক্ষ থেকে অব্যহত থাকবে।

আরো বলেন, সাধারণত গ্রামের ছেলে মেয়েরা দুরের পথের কারনে শহরের স্কুলে পড়ালেখা করতে চাই না। কিন্তু আরাফাত প্রতিবন্ধি হয়েও ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের স্কুলে পড়তে আসে। তার স্কুলের অন্যকোন ছেলেমেয়েরা আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়নি, শুধু আরাফাত ভর্তি হয়েছে। স্কুলে আসার ব্যপারে অভিভাবদের সাথে কথা হয়েছে, আমাদের পক্ষথেকে সবধরনের সহযোগিতা করা হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button