ঝিনাইদহের চোখ-
বিয়ের পর একটু বাড়তি উপার্জনের জন্য দেড় বছর আগে ঢাকায় যান শাহিন মিয়া (২৫)। সেখানে শুরু করেন অটোরিকশা চালানো। উপার্জন করে বাড়িতে যে টাকা পাঠাতেন, তা দিয়ে চলত শারীরিক প্রতিবন্ধী স্ত্রী, ১০ মাস বয়সী ছেলে আর বয়স্ক মায়ের খাওয়া-পরা। রাজধানীর তুরাগের রাজাবাড়ি এলাকায় বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে গত শুক্রবার রাতে শাহিনের মৃত্যুর পর দিশাহারা পুরো পরিবার।
শাহিন মিয়া ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বৃত্তিদেবী-রাজনগর গ্রামের প্রয়াত হাসান আলীর ছেলে। তাঁরা চার ভাই, এক বোন। শাহিন ছিলেন সবার ছোট।
আজ রোববার সকালে শাহিন মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির মধ্যে ছড়ানো–ছিটানো চেয়ার পড়ে আছে। বাড়িতে অনেক মানুষের আনাগোনা। একপাশে রাখা আছে কাঠের একটি বাক্স, যেটাতে করে শাহিন মিয়ার লাশ নিয়ে আসা হয়েছিল।
প্রতিবেশীরা জানান, গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় শাহিনের লাশ বাড়িতে আসে। রাতেই পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে লাশ। এখনো বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের ভিড়।
শাহিনের বড় ভাই ফিরোজার রহমান জানান, তাঁদের দুই মা। তাঁরা দুই ভাই ও এক বোন। আর ছোট মায়ের দুই ছেলে শাহিন মিয়া ও সাইদুল মিয়া। সাইদুল মিয়া কাতারে থাকেন। তাঁদের মাঠে কোনো চাষযোগ্য জমি নেই। ২০ শতক জমির মধ্যে শাহিনের পাওনা ৪ শতক। বাড়িতে টিনের দুটি ঘর ছিল শাহিন মিয়ার, যার একটিতে তাঁর স্ত্রী-সন্তান, আরেকটিতে মা সুফিয়া খাতুন থাকতেন। সাংসারিক কারণে শাহিন মিয়ার পড়ালেখা হয়নি। ছোট থেকেই অন্যের জমিতে কাজ করতে হয়েছে। একসময় রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ নেন। এভাবে কষ্ট করে চলছিলেন শাহিন।
ফিরোজার রহমান বলেন, আড়াই বছর হলো একই উপজেলার রামজয়পুর গ্রামের জামাল শেখের মেয়ে মুসলিমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছেন। মেয়েটির বাঁহাত ও ডান পাঁয়ে সমস্যা। বিয়ের পরও বাড়িতে থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করছিলেন। দেড় বছর আগে শাহিন কাজের আশায় ঢাকায় চলে যান। সেখানে তুরাগ এলাকায় থেকে আটোরিকশা চালাতেন। মালিকের রিকশা নিয়ে দিনে চালাতেন আর রাতে গ্যারেজের একপাশে শুয়ে থাকতেন। এভাবে কষ্ট করে উপার্জন করতেন। এর মধ্যেই শাহিন–মুসলিমার কোলজুড়ে আসে ছেলে হুসাইন মিয়া। ছেলের বয়স এখন ১০ মাস।
৬ আগস্ট দুপুরে তুরাগের ওই গ্যারেজে বিস্ফোরণে শাহিনসহ আটজন দগ্ধ হন। তাঁদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। একে একে চিকিৎসাধীন সবাই মারা যান। মেয়াদোত্তীর্ণ জীবাণুনাশক বের করে বোতল খালি করার সময় এ বিস্ফোরণ ঘটে বলে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে ঘটনা কীভাবে ঘটেছে, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি তাঁরা।
তুরাগে বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন রিকশা গ্যারেজ ও ভাঙারি দোকানের মালিক গাজী মাজহারুল ইসলাম। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে দুর্দশায় পড়েছেন স্ত্রী–সন্তানেরা। স্বামীর এভাবে মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাজহারুলের স্ত্রী রোকসানা আক্তার
শাহিনের মা সুফিয়া খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তাঁর ছেলে বাড়িতে প্রতিবন্ধী স্ত্রীকে রেখে ঢাকায় গিয়েছিলেন টাকা উপার্জন করতে। এখন লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরলেন। বাড়িতে স্ত্রী আর শিশুসন্তান আছে। এদের এখন কী হবে? ছেলের চিকিৎসায় ইতিমধ্যে বেশ কিছু টাকা ব্যয় হয়েছে। এখন তাঁদের হাতে ১০০ টাকাও নেই। এই অবস্থায় কীভাবে সংসার চালাবেন, প্রতিবন্ধী মেয়েটির কী হবে?
প্রতিবেশী আয়ুব হোসেন বলেন, শাহিন খুবই পরিশ্রমী ছিলেন। যখন যে কাজ পেয়েছেন, সেটাই করেছেন। এভাবে প্রতিবন্ধী স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালিয়েছেন। এখন মেয়েটি কোলের শিশুসন্তান নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবেন, সেটাই চিন্তার।