শৈলকুপার মনিরুজ্জামানের জৈব সার কারখানা সাড়া ফেলেছে জেলায়-জেলার বাইরে
আব্দুর রহমান মিল্টন, ঝিনাইদহ থেকে-
একটি বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থ ও হিসাব বিভাগ থেকে এমবিএ পাশ করে চাকুরীর আশায় না ঘুরে যুবক মনিরুজ্জামান সজীব তার নিজ এলাকা প্রত্যন্ত পল্লীতেই গড়ে তুলেছেন একটি জৈব সার কারখানা । যার নাম দিয়েছেন হারুন অর্গানিক এগ্রো ফার্ম ।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রঘুনন্দনপুর গ্রামে ২০২০ সালে এই উদ্যোগ নেন শিক্ষিত যুবক মনিরুজ্জামান সজীব। ২ধরনের জৈব সার তিনি তৈরী করছেন, এর একটি হলো ট্রাইকো কম্পোষ্ট আরেকটি হলো ভার্মি কম্পোষ্ট। এখান থেকে নিয়মিত জৈব সার উৎপাদন ও সরবরাহ করছেন। এই সার এখন ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও মাগুরা জেলাতেও যাচ্ছে, রয়েছে ব্যাপক চাহিদা।
মাত্র ২ বছরের ব্যবধানে উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান সজীবের জৈব সারকারখানাতে ১২ জন শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে । এখানে কাজ করে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। এসব শ্রমিকদের ভেতরে ১০জন পুরুষ ও ২জন নারী শ্রমিক রয়েছে।
জানাযায়, যুবক মনিরুজ্জামান সজীবের হারুন অর্গানিক এগ্রো ফার্মে প্রতিমাসে ৫০টন ট্রাইকো কম্পোষ্ট ও ৫টন ভার্মি বা কেঁচো কম্পোষ্ট তৈরীর সক্ষমতা রয়েছে কিন্তু পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাবে বর্তমানে ১৫টন ট্রাইকো কম্পোষ্ট ও ৩টন কেঁচো কম্পোষ্ট উৎপাদন হচ্ছে । এই সার উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল হচ্ছে গোবর । তবে তার নিজস্ব গরুর খামার না থাকায় বা এলাকায় স্থানীয়দের তেমন খামার না থাকায় ব্যহত হচ্ছে উৎপাদন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জৈব সার উৎপাদনে অন্যান্য যে কাঁচামালের যোগান লাগে তার মধ্যে ট্রাইকো কম্পোষ্টে ট্রাইকো ডার্মা পাউডার,গরুর গোবর, প্রেস মাড-আখের গাদ, কলাগাছ, কচুরপিানা, ছাই,খৈইল, চিটাগুড়,কাঠের গুড়া,সবজীর উচ্ছিষ্ট, ডিমের খোসা, নিম খৈইল, হাড়ের গুড়া, শিং কুচি, গাছের পাতা পচা, ব্যবহৃত চা পাতা সহ ইত্যাদি কাঁচামাল লাগে। এগুলো একত্রিত করে পর্য়ায়ক্রমে সেডে পচন ক্রিয়ার মাধ্যমে ৪৫-৫৫ দিনের মধ্যে উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার বানানো হয়।
আর ভার্মি কম্পোষ্ট বা কেঁচো কম্পোষ্টে গরুর গোবর, কলাগাছ ও কচুরিপানা লাগে। কেঁচো এগুলো খেয়ে যে মল ত্যাগ করে তাই উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার। এসব জৈবসারে পিএইচ, জৈব কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, কপার, সালফার, জিংক, ক্যালসিয়াম, আয়রণ ও ম্যাগনেশিয়াম সহ রয়েছে নানা বৈজ্ঞানিক উপাদান ।
শৈলকুপা কৃষি অফিস ও স্থানীয় কৃষকরা জানায়, এমন জৈব সারের রয়েছে নানা উপকারিতা। ফলন বৃদ্ধি ও গুনগত মান বাড়ায়, সব ঋতুতে সকল ফসলে ব্যবহার করা যায়, জৈব সার বীজের অংকুরোদগমে সহায়তা করে, মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, মাটির গঠন ও প্রকৃত গুন রক্ষা করে, মাটির উপকারী জীবানুগুলোর বংশবৃদ্ধি ও কার্যকারিতা বাড়ায়, মাটিতে রস মজুদ রাখতে সহায়তা করে, ফলে অধিক সেচের প্রয়োজন হয় না। জৈব সার ব্যবহারের ফলে আনুপাতিক হারে রাসায়নিক সারের মাত্রা কমানো যায়, মাটির ভেতরে বাতাস চলাচলে সহায্য করে, ফসলের সকল প্রকার খাদ্য যোগান দেয়। এই সার মাটিতে দেয়ার পর ৬ থেকে ১৮মাস পর্যন্ত প্রভাব থাকে যা পরবর্তী ফসলের জন্যেও কাজে লাগে ।
এসবের বিপরীতে রাসায়নিক সারের দাম বেশী, মানুষের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ও ঝুকি বেশী, পরিবেশেও হারায় ভারসাম্য এমনটি জানান কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা ।
উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান সজীব জানান, জৈবসার প্রতি শতকে সবজির জন্যে ৫ কেজি, পিয়াজ, আলু, ধান, গম, পাট সহ অন্যান্য ফসলের জন্য ৩ থেকে ৪ কেজি, মাছে বিঘা প্রতি ৪০ থেকে ৬০ কেজি, ফল গাছে ৫ থেকে ৭ কেজি করে ব্যবহার করা যায় । এছাড়াও সব ফসলে সব সময় এই জৈব সার ব্যবহার করা যায় ।
স্থানীয় কৃষক এবং শৈলকুপার বক্সীপুর বাজারের সার ব্যবসায়ী মাসুদ মিয়া জানান, তিনি নিয়মিত এখান থেকে সার ক্রয় করে বিক্রি করে থাকেন।
ঝিনাইদহের পাশের জেলা মাগুরার সার ব্যবসায়ী মো: সোহরাব হোসেন এই এগ্রো ফার্ম থেকে সার ক্রয় করে থাকেন। তিনি জানান কম মূল্যে পরিবেশ বান্ধব এবং নিরাপদ জৈব সার পেয়ে অনেক উপকৃত হচ্ছেন।
শৈলকুপার রঘুনন্দনপুর গ্রামে অবস্থিত হারুন এগ্রো ফার্মের ম্যানেজার রবিন হোসেন জানান, প্রতি কেজি জৈব সারের উৎপাদন খরচ গড়ে ১০ টাকার উপরে। ১৩ থেকে ১৫ টাকা দরে প্রতি কেজি বিক্রি হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবে বলে খামারে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীরা জানায় ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর শৈলকুপার কৃষি কর্মকর্তা ডক্টর মাহফুজুর রহমান জৈব সারের উৎপাদন-ব্যবহার ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রসঙ্গে জানান, শৈলকুপার প্রত্যন্ত পল্লীতে যে হারুন এগ্রোফার্ম গড়ে উঠেছে তা আমাদের জন্য সুখবর। তিনি বলেন, উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান সজীব কে সব ধরনের টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। সহজ শর্তে জামানত বিহীন লোন বা আর্থিক সাপোর্ট প্রসঙ্গে বলেন, যুব উন্নয়ন অফিস এমন উদ্যোক্তাদের লোন বা আর্থিক সাপোর্ট দিতে পারে।