ঝিনাইদহ সদর

স্বামী-সন্তানের রক্তের বিনিময়েও মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেল না ঝিনাইদহের আনোয়ারা

ঝিনাইদহের চোখঃ

স্বাধীনতা যুদ্ধে গুলিতে ঝাজরা হওয়া আনোয়ারা বেগম হারিয়েছেন স্বামী ও দুই সন্তান। পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল এই পরিবারের তিন সদস্যকে। শরীরে ৫ টি গুলির চিহ্ন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন আনোয়ারা বেগম। অসহ্য যন্ত্রণা তাতে।

আনোয়ারা বেগমের এই যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও তার নিহত স্বামী শামছদ্দিন মন্ডলের নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তি না হওয়ায়। অথচ আনোয়ারা বেগমের স্বামী ও দুই সন্তান জাহানারা বেগম এবং সিদ্দিকুর রহমানের নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিষয়খালী বাজারে প্রতিষ্ঠিত একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের প্রথম সম্মুখ প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য্য।ে এতো তথ্য প্রমাণ থাকার পরও পরিবারটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে কোন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়নি।

মহারাজপুর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার তোয়াজ উদ্দীন জানান, ১৯৭১ সাল। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিষয়খালীসহ আশপাশের নৃসিংহপুর, খড়িখালী ও বড় গড়িয়ালা গ্রামে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিষয়খালী ব্রিজ ভেঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। এই সুযোগে দিকভ্রান্ত হানাদার বাহিনী আশপাশ গ্রামে হত্যাযজ্ঞা শুরু করে। বড় গড়িয়ালা গ্রামের শামছদ্দিন মন্ডল রণাঙ্গন ছেড়ে দুপুরের খাবার গ্রহণের জন্য বাড়িতে যান। তখনই ঘটে যায় নির্মম ঘটনা।

পাকবাহিনী বড় গড়িয়ালা গ্রামে ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। এতে নিহত হন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী শামছদ্দিন মন্ডল, তার মেয়ে জাহানারা বেগম ও ৭ বছরের ছেলে সিদ্দিকুর রহমান। গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাতে থাকেন শামছুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। তাদেরকে একটি গর্তে মৃত ভেবে ফেলে রাখা হয়। ওই সময় শামছুদ্দিনের আরেক ছেলে আবু সামার বয়স ১০ বছর। সে সময়কার পাকবাহিনীর নিকষ কালো অন্ধকারময় স্মৃতি স্মরণ করে আবু সামা জানান, লাশের সাথে সেই গর্তে ছোপ ছোপ রক্ত। মৃত্যু যন্ত্রণায় মা আনোয়ারা বেগম কাতরাচ্ছেন। সেখান থেকে তাকে তুলে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান মা। এখনো তিনি মাথা ও পিঠে গুলির চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। আবু সামা অভিযোগ করেন, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার হিসেবে কত জায়গায় গিয়েছেন। কেউ তাদের দাবি মানেনি। এমনকি ঘাড় ধাক্কা দিয়েও জেলা কমান্ড কাউন্সিলের অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

তিনি মনে করেন টাকা না দেওয়ার কারণে তাদের পিতার নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্তি হয়নি। পিতা ও দুই ভাই বোনকে হারিয়ে অভিভাবকহীন হয়ে বড় হন মামা মুনতাজ আলীর সংসারে। তিনিই তাদের লালন পালন করেন। এ বিষয়ে মামা মুনতাজ আলী বলেন, তাদের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ না করেও অনেক মানুষ ভাতা পাচ্ছেন। অথচ তার ভগ্নিপতি দেশের জন্য জীবন দিলেও আজও কোন স্বীকৃতি পাননি। বিষয়খালী যুদ্ধে অংশ নেওয়া কেশবপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সোবাহান এক প্রত্যায়ন পত্রে উল্লেখ করেন, ‘মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শামছদ্দিন মন্ডলের পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ দুঃখের বিষয় তিনি, তার স্ত্রী, কন্যা ও ছেলের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় আমি মর্মাহত’। একই দাবি করেন খেদাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও নলডাঙ্গা ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মন্টু গোপাল বাবু। তিনি এক প্রত্যায়ন পত্রে জানান, ‘১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল শামছদ্দিন মন্ডল, তার মেয়ে জাহানারা বেগম ও ৭ বছরের ছেলে সিদ্দিকুর রহমান পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হন’। মহারাজপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন জানান, ‘রণাঙ্গনে শামছুদ্দীন মন্ডল যুদ্ধ না করলেও তিনি বিষয়খালী যুদ্ধে রণাঙ্গনে মুক্তি বাহিনীকে সহায়তা করেছেন। সেই হিসেবে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা’। বড় গিড়য়ালা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় এই পরিবারটির সদস্যরা একেবারেই হতদরিদ্র। ছেলেরা রাজমিস্ত্রি ও চা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। জরাজীর্ণ ঘরবাড়ি। নেই বাড়িতে স্যানেটারি ল্যাট্রিন। সরকারিভাবে এখনো কোন ভাতা এমনকি ভিজিডি ও ভিজিপিও দেওয়া হয় না। গুলিবিদ্ধ আনোয়ারা বেগম কয়েক বছর ধরে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। এতে তার দুরাবস্থা ঘোচে না। প্রতি মাসে তার চিকিৎসা ব্যয় ৩ হাজার টাকা। স্ট্রোকে প্যারালাইজড হয়ে গেছে শরীর। দরিদ্র সন্তানরা তার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিজেদের সংসারও ঠিকমতো চালাতে পারে না।

মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার হিসেবে তালিকায় নাম ওঠাতে নেই কোন কাগজপত্র। কেবল একমাত্র সম্বল এলাকায় বেঁচে থাকা এলাকার ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। তারাই এখন বড় সাক্ষী। তারপরও কেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি সে বিষয়ে জানান, বিষয়খালী যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সাবেক মুক্তিযোদ্ধা জেলা কমান্ডার কামালুজ্জামান। তিনি বলেন, সে সময় এলাকার বহু যুবক যুদ্ধ করেছে। আবার কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। কিন্তু যোগাযোগের অভাবে হয়তো শামছুদ্দীনের পরিবারটি তালিকায় নাম ওঠাতে পারেনি। তিনি বিষয়টি দেখবেন বলেও জানান।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button