ঝিনাইদহ মধুহাটি ভুমি সহকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ
মনজুর আলম, ঝিনাইদহের চোখঃ
ভিটে বাড়ি জমির ভুমি উন্নয়নের কর দিবেন কৃষক মজনুর রহমান ওরফে মজনু। তাই তিনি গেলেন ভুমি অফিসে। ইউনিয়ন সহকারি ভুমি কর্মকর্তা (নায়েব) বারবার হিসাব কষছেন, কখনও খাতা কলমে আবার কখনও মৌখিক ভাবে ক্যালকুলেটরের সাহায্যে। তিনি জানালেন, ৬ হাজার টাকা ছাড়া কখনও-ই কর পরিশোধ করা সম্ভব নয়। একটু কম দিয়ে কাজটি করে নিতে ঘুরছেন প্রায় ৪ মাস। কিন্তু হল না। নায়েবের হিসাব মত দুই দফায় ৬’হাজার টাকা পরিশোধ করলেন। এরপর একদিন হাসি খুশি মুখে নায়েব নানা বয়ান শুনিয়ে মজনুর হাতে দেয় মাত্র ৩ (তিন) টাকা ভুমি উন্নয়ন কর পরিশোধের একটি রশিদ। তিনি বাকি টাকার হিসাব জানতে চাইলেন এতে রাগে ক্ষোভে দূর্ব্যহার করে অফিসের বাইরে যেতে বলা হল তাকে।
মজনু ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ২নং মধুহাটি ইউনিয়নের নওদাপাড়ার ওয়াসেল আলি কবিরাজের ছেলে। তিনি এমনই ভাবে অভিযোগ করলেন তার ইউনিয়নের ভুমি সহকারি কর্মকর্তা ইলতুত মিসের বিরুদ্ধে। এমন অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা শুধু মজনুর নয়। নায়েবের বিরুদ্ধে একাধিক কৃষকের কর পরিশোধের রশিদ ছিড়ে অপমান অপদস্ত করাসহ, ক্ষমতার অপব্যবহার, কৌশলে ঘুষ বানিজ্য রাজনৈতিক গল্প ফেঁদে কৃষকদের নাজেহাল করার অভিযোগের অন্ত:নেই। এবিষয়ে একাধিক ভুক্তভোগি কৃষক লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অনুসন্ধান ও অভিযোগ জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ২নং মধুহাটি ইউনিয়নের ভুমি অফিসের ভুমি সহকারি কর্মকর্তা হিসাবে ইলতুত মিস যোগদান করার পর থেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেবা নিতে আসা কৃষকদের নানা ভাবে হয়রানি করে লাগামহীন ভাবে অর্থ বানিজ্য করে চলেছে।
তিনি- ইউনিয়নের নওদাপাড়া গ্রামের ওয়াসেল আলি কবিরাজের ছেলে মজনুর রহমান ওরফে মজনুর নিকট থেকে ৬’হাজার টাকা নিয়ে ৩ (তিন) টাকার ভুমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রসিদ, ওয়াড়িয়া গ্রামের মনোয়ার হোসেন মনার নিকট থেকে ১৩’শ টাকায় ২’শ ৬০ টাকার, লাল মোহাম্মদের ছেলে আকরাম হোসেনের নিকট থেকে ৪’হাজার টাকায় ২’হাজার ১৮ টাকার রসিদ, চোরকোল গ্রামের রমিজ উদ্দিন মোল্লার ছেলে বাচ্চু মোল্লার নিকট থেকে ১’হাজার ৮’শ টাকা নিলেও ৯০ ও ১৯০ টাকার পৃথক দুইটি রসিদ দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। মামুনশিয়া গ্রামের তালেব মিয়ার ছেলে মতিয়ার রহমান মতির নিকট থেকে ৩’হাজার টাকায় দেড়’শ টাকার, আব্দুল আজিজের ছেলে লাল মিয়ার ২’হাজার ৫’শ টাকায় ১৬ টাকার, এছাড়া চোরকোল গ্রামের চাঁদ মন্ডলের ছেলে কামাল হোসেন, দাউদ হোসেনের ছেলে জিয়া উদ্দিনের নাম পত্তন রিপোর্ট দেয়ার জন্য ৫’শ টাকা রসিদ ছাড়া নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে শ্যামনগর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে কাশের আলির জমি নামপত্তন করার জন্য ভুমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রসিদ এবং দলিল দেয়ার সময় ৫’শ টাকা নেয়ার পরও ২’হাজার ২’শ টাকা আরও দাবি করা হয়েছে। এ টাকা পরিশোধ না করলে কাজ হবেনা বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। এছাড়া কামতা গ্রামের হাবিবুল্লাহ মিয়ার ছেলের নিকট থেকে ১’হাজার টাকা নিলেও ১০ টাকার ভুমি উন্নয়ন কর পরিশোধ রসিদ, ওয়াড়িয়া গ্রামের ছামসুল ইসলামের ছেলে মিজানুর রহমান ওরফে মদিনের নিকট থেকে ৩’হাজার টাকা নেয়া হলেও তাকে ভুমি উন্নয়ন কর রসিদ দেয়া হয়নি। তার নিকট গেলেও রসিদ এমনকি টাকা কোন টাই তিনি ফেরত দিচ্ছেনা বলে অভিযোগ করেছেন।
অন্যদিকে মামুনশিয়া গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে লাল মিয়ার এবং বাজার গোপালপুরের পাঁচু মন্ডলের ছেলে রেজাউল ইসলামের ভুমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রসিদ ছিড়ে ফেলা এবং অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কোন কৃষক দেনায় জরাজীর্ণ হয়ে বা বিপদে পড়ে একপ্রকার বাধ্য হয়ে তার শেষ সম্বল জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কৃষক জমি বিক্রির পর জমির ক্রেতা রেজিস্ট্রির জন্য তাগাদা দেন। এসময় জমি বিক্রিত ঐই কৃষকের নিকট নগদ টাকা থাকে। তিনি রেজিস্ট্রি করে দেবার জন্য ভুমি অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং ভুমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রশিদের জন্য ভুমি সহকারি কর্মকর্তার নিকট যান। তখন তিনি কৃষকের হাতের নগদ টাকার সন্ধান পেয়ে নানা কৌশলে হয়রানি শুরু করেন। এক পর্যায়ে ভুক্তভোগি কৃষক নায়েবের চাহিদা মত টাকা দিতে বাধ্য হয়।
এবিষয়ে চোরকোল গ্রামের ভুক্তভোগি গোলজার হোসেন বলেন, তিনি (ভুমি সহকারি কর্মকর্তা) লেখা-পড়া জানাতে পারেন, সরকারি চাকুরিও করতে পারেন, তবে লোক হিসাবে ভালো নয়। কারন হিসাবে তিনি বলেন, গ্রামের কৃষকরা তার নিকট গেলে আজ যেভাবে হেনস্ত হচ্ছে। পূর্বে কোন ভুমি সহকারি কর্মকর্তার নিকট থেকে এমনটা হয়নি। এমকি তিনি নিজেও একজন ভুক্তভোগি।
এবিষয়ে মামুনশিয়া গ্রামের মেম্বর ও আওয়ামী লীগ নেতা জসিম উদ্দিন বলেন, আমার গ্রামের একাধিক কৃষককে হয়রানি করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়েছে। তারা আমার নিকট এমন অভিযোগ করেছে। বিষয়টি তদন্ত পূর্বক সঠিক ব্যবস্থার গ্রহন করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এবিষয়ে ভুক্তভোগি মামুনশিয়া গ্রামের সাবেক মেম্বর আনছার আলি জানান, আমাদের জমির জন্য গেলে, তিনি বাড়ির জমির ভুমি কর পরিশোধের রসিদ আনতে বলেন। রসিদ নিয়ে গেলে তিনি বলেন এটা সঠিক বা বৈধ ভাবে দেয়া হয়নি। তিনি আরও জানান, এটা নিয়ে আমি পূর্বের অফিসারের সাথে কথা বলে জেলা প্রশাসকের নিকট অভিযোগ করবেন বলে তিনি জানান।
এবিষয়ে অভিযুক্ত ২নং মধুহাটি ইউনিয়ন ভুমি অফিসের ভুমি সহকারি কর্মকর্তা ইলতুত মিশের নিকট মোবাইলে জানতে চাইলে তিনি, তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার অফিসে দালাল মুক্ত করার জন্য কিছু লোকজনকে আমি বের করে দিয়েছি। আর কিছু লোক তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলেও তিনি অভিযোগ করে বলেন।
এবিষয়ে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বদরুদ্দোজা শুভ এর নিকট জানাতে চাইলে, তিনি কথাগুলো শুনে কোন মন্তব্য করেননি।
তবে বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ইউনিয়নের ভুক্তভোগি কৃষকবৃন্দ।