ঝিনাইদহ মিয়ার দালানে একদিন
আসিফ আল আজাদ, ঝিনাইদহের চোখ-
ঝিনাইদহ জেলা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের দ্যুতিতে বর্ণময় এ জেলা। ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অফুরান সম্পদে সমৃদ্ধ এ জনপদ ঝিনাইদহ। খেজুর গুড়, কলা-পানের প্রাচুর্য মন্ডিত ঝিনাইদহের রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। প্রকৃতির সজীবতা এবং প্রাণ জুড়ানো আবহাওয়া ছাড়াও এই জেলায় রয়েছে চমৎকার প্রাচীন মসজিদ, মন্দির এবং প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর বিভিন্ন ভবন। প্রাচীনকালে নির্মিত এসব স্থাপনায় রয়েছে চমৎকার শৈল্পিক কারুকাজ।
মনের অবসাদ দূর করতে ভ্রমণ বা বিনোদনের কোনো বিকল্প নেই। আর তা যদি হয় প্রাচীন পুরাকীর্তি বা জমিদার বাড়ি তবে তো কথাই নেই। যান্ত্রিক জীবনে শত ব্যস্ততার বাইরে ভ্রমণপ্রেমীদের জন্যে আদর্শ ভ্রমণ স্থান হতে পারে ঝিনাইদহের মিয়ার দালান। যার দেয়ালের পরতে পরতে সৌন্দর্যের ছোঁয়া। শানশওকত আর চাকচিক্যের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে দেশের বেশিরভাগ জমিদার বাড়িই এখন পরিত্যক্ত। মিয়ার দালান ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত একটি পুরানো জমিদার বাড়ি। এটি নবগঙ্গা নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত। ঝিনাইদহ শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।
গত সোমবার (১৩ জুলাই) দুপুর ৪টায় শুরু হলো আমাদের মিয়ার দালান যাত্রা। মহামারি কোভিড-১৯–এর প্রাদুর্ভাবের কারণে যাত্রা শুরুর আগে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে ভালো করে সবাই হাত ধুয়ে নিলাম এবং মুখে মাস্ক পরে বের হলাম। আমরা ৮জন বন্ধু, ৪টি মটর সাইকেল নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলার মহিলা কলেজ গেট থেকে নলডাঙ্গা গ্রামের সড়ক ধরে চলে গেলাম মিয়ার দালান। যতই গ্রামের পথ চলছি, ততই প্রকৃতিপ্রেমে পড়ে যাচ্ছি। জীবনের পুরো সময় এই প্রকৃতির মধ্যে কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা করছে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।
বলে রাখা ভাল কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে ঝিনাইদহ জেলার দূরত্ব ১৫ কিঃমি। কিন্তু আমরা মহাসড়ক ধরে না যাওয়াই ৩০ মিনিট সময় বেশি লাগল। বিকেল থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমরা ওখানেই ছিলাম। ঘুরে ঘুরে দেখলাম দালানের চারপাশ। বন্ধুরা স্মৃতি ধরে রাখতে নিজেদের মত করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সেলফি, গ্রুপ ছবি তুলে নিল। তারপর ওখান থেকে ঝিনাইদহ শহরে কিছুক্ষণ ঘুরে চলে এলাম কালীগঞ্জে। সময় চলে যায়, তবে স্মৃতিগুলো থেকে যায় আজীবন। তেমনি মিয়ার দালান ভ্রমণের স্মৃতিগুলো মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে আজীবন। হয়তো আবার দেশ সুস্থ হলে স্মৃতিচারণা করে ঘুরে বেড়াব এই শহরের পথে ঘাটে।
মিয়ার দালান’র সিঁড়িতে লেখক ও তার বন্ধুরা। ছবি- লেখকের পক্ষ থেকে
যতদূর জানা যায়, ১২২৯ বঙ্গাব্দে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু করেন তত্কালীন জমিদার সলিমুল্লাহ চৌধুরী। ৭৫ হাজার টাকা ব্যয়ে বাড়িটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১২৩৬ বঙ্গাব্দে। সলিমুল্লাহ চৌধুরী স্থানীয়দের কাছে মিয়া সাহেব নামে পরিচিত ছিলেন। সেজন্য বাড়িটি মিয়ার দালান বলে পরিচিতি পায়। তবে যে জমিদার এই দালানটি নির্মাণ করেন তিনি ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় ভবনটি বিক্রি করে দেন সেলিম চৌধুরী নামের এক ব্যক্তির কাছে। তাই ভবনটিকে স্থানীয় ভাবে কেউ কেউ সেলিম চৌধুরীর বাড়িও বলে থাকে।
কথিত আছে, সলিমুল্লাহ চৌধুরীর পিতা বধুই বিশ্বাস ছিলেন নলডাঙ্গা রাজবংশের দেওয়ান। বধুই বিশ্বাসের মৃত্যুর পর সলিমুল্লাহ নলডাঙ্গা রাজবংশের কর্মচারী হিসেবে যথেষ্ট উন্নতি করেন এবং তাকে চৌধুরী উপাধি দেয়া হয়। তিনি মুরারী নামে এক হিন্দু রমণীর প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেন। পরবর্তী সময়ে ওই নারীর নাম পরিবর্তন করে বিবি আশরাফুন্নেসা রাখা হয়। মিয়ার দালানের প্রধান ফটকে খোদাই করা লেখায় তার কথাসহ নির্মাণের বিষয় উল্লেখ রয়েছে।
তাতে লেখা আছে, ‘শ্রী, শ্রী রাম, মুরারীদহ গ্রাম ধাম, বিবি আশরাফুন্নেসা নাম, কি কহিবা হুরির বাথান। ইন্দ্রের অমরাপুর নবগঙ্গার উত্তর ধার, ৭৫,০০০ টাকায় করিলাম নির্মাণ। এদেশে কাহার সাধ্য বাধিয়া জল মাঝে কমল সমান। কলিকাতার রাজ চন্দ্র রাজ, ১২২৯ সালে শুরু করি কাজ, ১২৩৬ সালে সমাপ্ত দালান।’
বলা হয়ে থাকে, বাড়িটি থেকে নবগঙ্গা নদীর নিচ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ ছিল। সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ এখনো চিহ্নিত করা যায়। নদীতে যেভাবে বাধ দিয়ে ইমারতটি নির্মাণ করা হয়েছিল সেভাবে তৈরি আর কোনো পুরনো ইমারত ঝিনাইদহ শহরে দেখা যায় না। বাড়িটির ব্যাপক পরিচিতির একটি বড় কারণ একটি বিশেষ খেজুর গাছ। যে গাছটিতে একাধিক মাথা ছিল এবং প্রতিটি মাথা থেকেই রস আহরণ করা যেত। তবে এখন আর খেজুর গাছটি নেই।
বাড়িটি দেখলে মনে হয় এটি নদীগর্ভে দাঁড়িয়ে আছে। চুন-সুরকির সঙ্গে ইটের গাঁথুনিতে এ বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। বাড়িটির দেয়াল ২৫ ইঞ্চি পুরু। উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্য প্রায় ৮২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৬৬ ফুট। এ ভবনে ছোট-বড় ১৬টি কক্ষ রয়েছে। দ্বিতীয় তলার ছাদের ওপর রয়েছে একটি চিলেকোঠা। শ্বেতপাথর দিয়ে আচ্ছাদিত এই চিলেকোঠা নামাজ ঘর হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল।
তবে সংরক্ষণ আর তদারকির অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ২০০ বছর আগে নির্মিত এই মিয়ার দালান। কয়েক বছর আগেও এ স্থাপত্য দেখতে দর্শনার্থীরা ভিড় করলেও এখন কেউ সেদিকে পা বাড়ান না। স্থানীয়দের মতে, যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে এ স্থাপনা হয়ে উঠতে পারে অন্যতম পর্যটন স্পট।
দেশের যেকোনো স্থান থেকে ঝিনাইদহ শহরে পৌঁছে ইজিবাইক, ভ্যান, রিকশাযোগে মিয়ার দালান জমিদার বাড়ি যাওয়া যায়।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী, ই-মেইল: asifsavar@gmail.com