ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বিষমুক্ত সবজি গ্রাম মোস্তবাপুর
জামির হোসেন, ষ্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহের চোখ-
কালীগঞ্জের নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মোস্তবাপুর গ্রাম। গ্রামটি ইতোমধ্যে নিরাপদ সবজির গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। মোস্তবাপুর ছাড়াও অনুপমপুর ও শালিখা গ্রামের শতাধিক নারী বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে জড়িত রয়েছেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে ২০ গৃহিণী ও সবজি উৎপাদনকারীর নাম দিয়ে গ্রামে একটি সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘নিরাপদ সবজি গ্রাম’।
পেশায় তাঁরা গৃহিণী। গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশিই বাড়ির আঙিনায় পতিত জমিতে করছেন বিষমুক্ত নিরাপদ সবজির আবাদ। সেখানে কেউ লাগিয়েছেন কচু, শিম, বেগুন; কেউবা কুমড়া, লাউ, লালশাকসহ বিভিন্ন রকমের সবজি। কোনো ধরনের রাসায়নিক সার ছাড়াই তাঁরা জৈব সার ব্যবহারের মাধ্যমে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদন করছেন। এসব সবজি নিজ পরিবারের চাহিদা মেটানোর পরও বাকিটা বিক্রি করে বাড়তি আয় করছেন।
সবজি বিক্রির জন্য গ্রামেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিরাপদ বিষমুক্ত সবজির হাট। এ হাটের উদ্যোক্তাও একজন নারী। মনোয়ারা বেগম নামে ওই উদ্যোক্তার বাড়িতেই প্রতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার হাট বসে। যেখানে শুধু বিষমুক্ত সবজি উৎপাদকরাই সবজি নিয়ে আসেন। এখানে সবজি বিক্রি করলে বাজারের চেয়ে কেজিপ্রতি তিন-চার টাকা বেশি পাওয়া যায় বলে জানান চাষীরা।
কালীগঞ্জ শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মোস্তবাপুর গ্রাম। এ গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের নারী বাড়ির আঙিনায় পতিত জমিতে জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করছেন। এর পাশাপাশি অধিকাংশ নারী তাঁদের বাড়িতে কেঁচো কম্পোস্ট সারও তৈরি করেন। এই সার তাঁরা নিজেদের জমিতে ব্যবহার ছাড়াও বাজারজাত করে থাকেন।
সরেজমিন মোস্তবাপুর গ্রামটিতে গেলে গৃহিণী সাইদা, মুসলিমা, শারমিন, ডালিম বেগমসহ অন্যরা জানান, বাড়ির আঙিনায় পতিত জমিতে কলা, পুঁইশাক, লালশাক, কচু প্রভৃতি চাষ করে থাকেন। তাঁদের এ কাজে উৎসাহ ও সার্বিক সহযোগিতা করেন সবজি হাটের উদ্যোক্তা মনোয়ারা বেগম। গৃহিণীরা বলেন, কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে উৎপাদিত এসব সবজি মনোয়ারা বেগম কিনে নেন।
রাবেয়া খাতুন নামে এক গৃহিণী বলেন, তিনি ১৪-১৫ রকমের সবজি উৎপাদন করছেন। জমিতে ভার্মি কম্পোস্ট সার আর জৈব বালাইনাশক দিতে মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা খরচ হয়। সংসারের চাহিদা মিটিয়ে প্রতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার মনোয়ারা বেগমের সবজি হাটে নিয়ে ২০ থেকে ২৫ কেজি বিক্রি করে থাকেন। সেখানে বাজার দরের চেয়েও কিছু বেশি টাকা পাওয়া যায়। প্রতি মাসে খরচ বাদে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা লাভ পান।
অনুপমপুর গ্রামের গৃহিণী রোকসানা বেগম জানান, তিনি লেবু, কুমড়া, কচুসহ ১০-১২ রকমের সবজি আবাদ করছেন। মনোয়ারার সবজি হাটে কুমড়া ৩০ টাকা কেজি ও লাউ পিস ২৫-৩০ টাকা দরে বিক্রি করেন। মাসে খরচ বাদে তাঁর চার-পাঁচ হাজার টাকা মুনাফা আসে।
তিনি জানান, চাষের সময় কখনও কম্পোস্ট সার বা জৈব বালাইনাশক সংকট হলে বিনামূল্যে এগুলো বিতরণও করে থাকেন মনোয়ারা।
কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মোস্তবাপুর গ্রামের আবদুস সাত্তারের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য। এ ছাড়াও তিনি কম্পোস্ট, জৈব বালাইনাশক উৎপাদক ও বিষমুক্ত সবজি বাজারজাত করেন। সামাজিক কার্যক্রমের কারণে তিনি খুলনা বিভাগীয় শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার, জাপানভিত্তিক হাঙ্গার ফ্রি প্রাইজ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ও এলজিইডি পুরস্কার পেয়েছেন।
মনোয়ারা বেগম জানান, নিয়ামতপুর ইউনিয়নের মোস্তবাপুর, অনুপমপুর ও শালিখা গ্রামের শতাধিক নারীকে তাঁদের বাড়িসংলগ্ন পতিত জমিতে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের পরামর্শ দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় তাঁদের বিনামূল্যে সবজির বীজ, ভার্মি কম্পোস্ট ও জৈব বালাইনাশকও দিয়ে থাকেন তিনি। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতি ও সোমবার বিকেল ৩টায় তাঁর বাড়ির উঠানে হাট বসান। গৃহিণীরা তাঁদের উৎপাদিত সবজি এ হাটে নিয়ে আসেন। তিনি প্রতি হাটে আসা ১০-১২ মণ সবজি কিনে থাকেন। সেই সবজি কিনে ক্যারেটে সাজিয়ে তিনি পিকআপ বা বাসযোগে ঢাকার প্রাকৃতিক কৃষি নামে বিষমুক্ত সবজির দোকানে সরবরাহ করেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মোহায়মেন আক্তার জানান, তিনি এ ইউনিয়নের নারীদের নিরাপদ সবজি চাষ দেখতে ও পরামর্শ দিতে কয়েকবার গেছেন। দেখেছেন, নারীরা তাঁদের বাড়িতে তৈরি শতভাগ জৈব সার দিয়ে সবজি চাষ করেন। কখনোই রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না।
কৃষানিদের তালিকাসহ নিরাপদ সবজির গ্রাম নাম দিয়ে কৃষি অফিস থেকে এ গ্রামে সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছে। এ কারণে এ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে জৈব পদ্ধতিতে নিরাপদ উপায়ে সবজির উৎপাদন বেড়েছে।