যে কারণে হা-ডু-ডু বাংলাদেশের জাতীয় খেলা
বাংলাদেশের জাতীয় খেলার নাম যে হা-ডু-ডু এ তথ্য আমাদের প্রায় সবারই জানা। তবে এ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো খেলাটি কখনো দেখেই নি। বিশেষ করে যাদের জন্ম শহরে এবং সেখানেই বেড়ে উঠেছে, গ্রামের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ একেবারেই নেই, তাদের ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আর দেখে থাকলেও সেটি হয়েছে টেলিভিশনের কল্যাণে। টিভিতে খেলার খবরে এক ঝলক দেখেছো হয়তো। অবশ্য সেটি তোমাদের দোষ নয়, এটি আমাদের ব্যর্থতা।
হা-ডু-ডু জাতীয় খেলা হলেও সেটিকে আমরা জনপ্রিয় করতে পারিনি। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি’র মতো ভিনদেশি খেলার দাপটে বেচারা হা-ডু-ডু বড়ই কোনঠাসা।
এক সময় গ্রামীণ জনপদে হা-ডু-ডু, দাড়িয়াবান্ধা, মোরগের লড়াই, গোল্লারছুট এর মতো খেলাগুলো ছিল বিনোদন ও আনন্দ-উৎসবের অন্যতম বড় উপাদান। পড়াশোনা ও কাজের বাইরে এসব খেলায় মেতে থেকে শিশু-কিশোর-যুবারা সময় কাটাতো পরম আনন্দে। এখন গ্রামেও বিনোদন ও সময় কাটানোর প্রধান সম্বল হয়ে উঠেছে টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি। আয়েশ ভর করছে তাদের মধ্যেও। শারীরিক শ্রমের খেলা তাদের আর টানে না। অন্যদিকে শহরের পরিবেশই হা-ডু-ডু’কে পরদেশি করে রেখেছে।
হা-ডু-ডু আর কাবাডি কী একই খেলা?
বইপুস্তক পড়ে অনেকেই আমাদের জাতীয় খেলা কোনটি তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। কোনো বইয়ে লেখা হা-ডু-ডু। আবার কোনো বইয়ে লেখা কাবাডি। মজার বিষয় হচ্ছে দুটো তথ্যই ঠিক। একটিও ভুল নয়। কারণ দুটোই যে একই খেলার ভিন্নতর নাম। যেমন গাছের আরেক নাম বৃক্ষ; বাঘের অপর নাম শার্দুল।
তবে হা-ডু-ডু এবং কাবাডির মধ্যে সূক্ষ্ম কিছু পার্থক্যও আছে। কাবাডি হচ্ছে হা-ডু-ডু’র একটু পরিমার্জিত রূপ। কাবাডি খেলার কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে, যা সারা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু হা-ডু-ডু একেক অঞ্চলে একেক নিয়মে খেলা হয়।
হা-ডু-ডু’র ইতিহাস
হা-ডু-ডু খেলা এই অঞ্চলে কবে থেকে শুরু হয়েছে, তার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। তবে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই ধরনের খেলা চলে আসছে এই বাংলায় এবং ভারতীয় উপ-মহাদেশে।
হা-ডু-ডু থেকে কাবাডি
জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ১৯৭২ সালে হা-ডু-ডু খেলাকে কাবাডি নামকরণ করা হয়। একই সময়ে এ খেলাকে জাতীয় খেলার মর্যাদা দেওয়া হয়। কাবাডির জন্য চুড়ান্ত করা হয় কিছু নিয়মকানুন।
হা-ডু-ডু বা কাবাডি খেলার ধরন
সাধারণত হা-ডু-ডু খেলার মাঠের কোনো সুনির্দিষ্ট মাপ থাকে। খেলায় অংশগ্রহণকারীরা যে জায়গায় খেলা হবে তার আকার বিবেচনায় নিয়ে নিজেরা আলোচনা করে চারদিকে দাগ দিয়ে খেলার মাঠের সীমানা ঠিক করে নেয়। তবে পরিমাণের দিক থেকে মাঠ যত বড়-ছোটোই হোক না কেনো, এর আকৃতি হয় আয়তাকার। মাঝখানে দাগ দিয়ে মাঠকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিভাগে একেকটি দল অবস্থান নেয়। অন্যদিকে কাবাডি মাঠের আকার হয় দৈর্ঘ্যে ১২.৫০ মিটার, প্রস্থে ১০ মিটার।
নিয়ম অনুসারে, এক পক্ষের একজন খেলোয়াড় অপর পক্ষের কোর্টে হানা দেয়। এ সময় সে শ্রুতিগোচরভাবে হা-ডু-ডু, হা-ডু-ডু বা কাবাডি কাবাডি কাবাডি শব্দ করতে করতে অন্য ওই পক্ষের যে কোনো একজন খেলোয়ারকে ছুঁয়ে ফিরে আসার চেষ্টা করে। ওই পক্ষের চেষ্টা থাকে সবাই মিলে তাকে জাপটে ধরে আটকে রাখা। যদি ওই খেলোয়াড় দম ধরে রেখে নিজ কোর্টে ফিরে আসতে পারে, তাহলে তার দল পয়েন্ট পায়। আর যদি আটকে থাকা সময়ের মধ্যে খেলোয়াড়টির দম ফুরিয়ে যায়, তাহলে বিপক্ষ দল পয়েন্ট পায়।
কেনো হা-ডু-ডু, কাবাডির প্রচলন
কেনো বা কীভাবে খেলা হিসেবে হা-ডু-ডু বা কাবাডির প্রচলন হয়েছিল, তার কোনো ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায় না। নৃবিজ্ঞানীরাও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো মতামত দেননি। তবে ধারণা করা হয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগে এক গোত্রের মানুষ অন্য গোত্রের আস্তানায় হানা দিয়ে ধনসম্পদ, গবাদিপশু, এমনকি নারী ও শিশুকে লুট করে আনতো। শত্রুর আস্তানায় হানা দিয়ে নিরাপদে ফিরে আসার কৌশলের চর্চা ও নিজেদেরকে ফিট রাখার তাগিদ থেকে এমন খেলার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল ওই যুগের মানুষ।
ব্যক্তি ও দলগতভাবে শত্রুপক্ষের আক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়া এবং সাথে সাথেই পাল্টা আক্রমণের কৌশল চর্চা করতে গিয়েই সম্ভবত এ খেলার উদ্ভব। এ খেলায় সফলতার শর্ত হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক ক্ষিপ্রতা, পেশীর ক্ষিপ্রতা, ফুসফুসের শক্তি ও সহনশীলতা, দ্রুত চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও তা প্রয়োগের সামর্থ। সেইসঙ্গে প্রতিপক্ষের কৌশল ও মনোভাব অনুধাবনের যোগ্যতাও গুরুত্বপূর্ণ।
হা-ডু-ডু (কাবাডি) কেনো জাতীয় খেলা
হা-ডু-ডু বা কাবাডিকে কেনো জাতীয় খেলার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সরকারি কোনো দলিলে এর ব্যাখ্যা নেই। এমনকি এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া’তেও এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে দুটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে এ খেলাকে জাতীয় খেলার মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
গ্রামনির্ভর এই দেশে এক সময় ব্যাপকভাবে হা-ডু-ডু খেলার প্রচলন ছিল। গ্রামাঞ্চলে এটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় দলগত খেলা। শুধু স্বীকৃত খেলার মাঠ নয়, গ্রামের পাশের পতিত জমি, বালুচরসহ যে কোনো সুবিধাজনক জায়গায় দাগ দিয়ে কোর্ট বানিয়ে তরুণরা এই খেলা শুরু করে দিত। তরুণরা তখন খেলার পাশাপাশি এটিকে এক ধরনের শরীর চর্চা ও শক্তিমত্তার পরীক্ষা হিসেবে নিত। অন্যদিকে গ্রামবাসী দলবেঁধে এই খেলা উপভোগ করতো। দেশজুড়ে খেলাটির এই জনপ্রিয়তার কারণে এটিকে জাতীয় খেলার ময়াদা দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
অন্যদিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতের সঙ্গেও এর মিল রয়েছে। পাকিস্তানীরা আমাদেরকে আক্রমণ করে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু বাঙালি জাতি পাল্টা আক্রমণ করে তাদের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে। জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। হা-ডু-ডু বা কাবাডি খেলার স্পিরিটের সঙ্গে এর একটি দারুণ সামঞ্জস্য আছে। এটিও খেলাটিকে জাতীয় খেলার মর্যাদায় অভিষিক্ত করার বিষয়ে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে।
ভারতের ছয় রাজ্যের জাতীয় খেলা
হা-ডু-ডু বা কাবাডি শুধু বাংলাদেশেরই জাতীয় খেলা নয়। প্রতিবেশী ভারতের ছয়টি রাজ্যের জাতীয় খেলা এটি। রাজ্যগুলো হচ্ছে- তামিলনাডু, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার ও পাঞ্জাব। অবশ্য বিভিন্ন প্রদেশে খেলাটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।তামিলনাডুতে এ খেলাটি কাবাডি, সাডুগুডি, গুডুগুডু, পালিঞ্জাডুগুডু ও সাডুগুডাত্থি নামে পরিচিত।