সবার উপরে বাবা-মা
যে-কোনো মানুষের গায়ে হাত তোলাই অপরাধ। আর সন্তান হয়ে বাবা-মায়ের গায়ে হাত উঠানো তো গর্হিত অপরাধই বটে! কয়েক দিন আগে বাবার গালে থাপ্পড় মারার নিকৃষ্ট একটি ভিডিও ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। সেই কুলাঙ্গার ছেলে অবশেষে গ্রেপ্তারও হয়। সে জঘন্য কাজের কথা আর নিরীহ বাবার অসহায় মুখটি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। সেদিন ভিডিওটি দেখার পর অফিস শেষে যখন ক্লান্ত শরীরে বাসে করে বাসায় ফিরছিলাম, সে বেদনাদায়ক বর্বর দৃশ্যটিই বারবার চোখে ভেসে উঠছিল। আর অজান্তেই চোখ ভিজে যাচ্ছিল। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল এই ভেবেÑ যদি পাছে কেউ দেখে ফেলে, তাহলে কী মনে করবে। কিন্তু অশান্ত মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে অস্থির বোধ করছিলাম।
আমাদের মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতা বোধ কোন তলানিতে গিয়ে নেমেছেÑ ভাবতেই বিষাদে মন ছেয়ে যাচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়েই দু’কলম লিখতে বসা। ছেলে গ্রেপ্তার হওয়াতেও বোধহয় সেই নির্যাতিত বাবাই সন্তানের জন্য বেশি কষ্ট পান। তিনি বারবার বলেছিলেন, ‘ওর (ছেলেকে উদ্দেশ করে) মায়ের ডায়াবেটিস, আমি ছেলেকে জিজ্ঞেস না করেই ওর মাকে মিষ্টি দিয়েছি। এজন্য রেগে গিয়ে সে আমার গায়ে হাত তুলেছে। কিন্তু এ কথা তো আমি কাউকে বলিনি।’ ধরে নিলাম, বাবার গায়ে হাত তোলার অপরাধে হয়তো ছেলের শাস্তি হলো।
তবে এতে কি তার চিন্তাভাবনা শুদ্ধ হবে, মনুষ্যত্ববোধ আদৌ জাগ্রত হবে? বিবেকবোধসম্পন্ন উন্নত মনের মানুষ হতে হলে প্রয়োজন সুশিক্ষা, মমত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ ও দায়িত্ববোধ। বাবা-মা নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে লালনপালন করেন। অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে, কখনও নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান। সন্তানকে সুশিক্ষিত ও সুযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন, এমন উদাহরণ অনেক রয়েছে।
আবার বাবা রিকশা চালিয়ে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ক্ষেতে কাজ করে সন্তানের পড়ার খরচ জোগাড় করেন, এমন বাবার উদাহরণও ভূরি ভূরি। নিজে ছেঁড়া জামা-জুতা পরে সন্তানকে পড়াশোনা করান সত্যিকার অর্থে মানুষ করার প্রত্যাশায়। সেই সন্তান পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যদি বাবা-মাকে অবজ্ঞা-অবহেলা করে, সন্তান যদি বড় হয়ে বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দেয়, বাবা-মাকে অপদস্থ করে, অপমান করে, এমনকি গায়ে হাত তোলার মতো জঘন্য কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করে নাÑ এ ব্যথা রাখার জায়গা কোথায়!
যে বাবা-মা সন্তানের সুখের জন্য নিজের আরাম-বিশ্রাম সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সন্তান অসুস্থ হলে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে তার পাশে বসে সুস্থতা কামনা করেন, সেই সন্তান বড় হয়ে, উপযুক্ত হয়ে যদি বাবা-মাকেই অসম্মান, অবহেলা করে, তাহলে সে শিক্ষার কী মূল্য আছে?
বাবা-মায়ের স্থান সবার ওপরে। প্রতিটি ধর্মেও বাবা-মাকে সম্মান করার কথা, সন্তান হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ আছে। বাবা-মায়ের জন্যই আমরা পৃথিবীতে আসতে পেরেছি। সন্তানকে বাবা-মায়ের মতো এমন নিঃস্বার্থভাবে কেউ ভালোবাসতে পারেন না।
সব ধর্মই বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনের শিক্ষা দেয়। ঘুমন্ত মায়ের শিয়রে বায়েজিদ বোস্তামির (রহ.) সারারাত পানি হাতে দাঁড়িয়ে থাকার কথা আমরা জানি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির কথাও সর্বজনবিদিত। সনাতন ধর্মে তো দেবীকে মা বলে ডাকা হয়।
আর ডিজিটাল যুগের করপোরেট সভ্যতা সন্তাদের এমন পশুতে পরিণত করছে যে, আইন করে শাস্তি দিয়ে তাদের বাবা-মায়ের দেখভাল করতে বাধ্য করতে হচ্ছে।
বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনেকের ভেতরই আছে। মমতাময়ী মায়ের আঁচলই আমাদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়।
বাবা-মা নিজের জীবনের রক্তবিন্দু দিয়ে তিল তিল করে আমাদের বড় করে তুলেছেন। শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মা ১০ মাস কষ্ট সহ্য করে আমাদের গর্ভে ধারণ করে চিরঋণী করেছেন। সে ঋণ শোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
গানের ভাষায়, ‘মায়ের একধার দুধের দাম/কাটিয়া গায়ের চাম/পাপোশ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না/এমন দরদি ভবে কেউ হবে না আমার মা।’
সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসা হলো নির্লোভ, নির্ভেজাল। সন্তানের জন্য বাবা-মা নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। কিন্তু অপ্রিয় ও তিক্ত সত্য হলো, কালপরিক্রমায় সন্তান হয়ে ওঠে অতি নির্মম। বাবা-মায়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ পেতে থাকে তাদের প্রতি সন্তানের চরম অবহেলা ও অবজ্ঞা। স্বামী-স্ত্রী ও আদরের ছেলেমেয়ে নিয়ে গড়ে ওঠে সুখের সংসার। আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে কিংবা ফুটপাতে।
পরিবার-পরিজন, ছেলেমেয়ে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক চরম অসহায় জীবনযাপন করেন তারা। সন্তান একবারও ভাবেন না, তাদের নিজের সন্তান যেমন প্রিয়, তারাও তাদের বাবা-মায়ের কাছে তেমন প্রিয়। তারা তাদের সন্তানকে যেমন আদর-সোহাগ করে, মায়া-মমতা দিয়ে পরম যতেœ লালনপালন করছে, তাদের বাবা-মাও তাদের মায়া-মমতা দিয়ে, আদর-স্নেহ দিয়েই বড় করেছেন। বাবা-মা নিজে না খেয়ে তাদের খাইয়েছেন। নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। তাদের সুখের দিকে তাকিয়ে তারা আরামের ঘুম হারাম করেছেন। তাদের মুখে দুই মুঠো খাবার তুলে দেওয়ার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। লালনপালন কষ্ট মনে করে সন্তানকে কোনো শিশু আশ্রমে তারা পাঠিয়ে দেননি।
ইসলাম বাবা-মায়ের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের সেবাযতœ করা, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের মান্য করা ইসলামের দৃষ্টিতে ফরজ। বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়া, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, তাদের কথা অমান্য করা নিঃসন্দেহে অনেক বড় গোনাহ।
বাবা-মা যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তাদের প্রতি সন্তানের দায়দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়, তাদের সেবা-শুশ্রƒষা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বার্ধক্যের কারণে বাবা-মায়ের মেজাজ কিছুটা খিটখিটে ধরনের হয়ে যেতে পারে। তাই তাদের অস্বাভাবিক আচরণকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার নির্দেশ রয়েছে ইসলামে। কোরআনে বলা হয়েছেÑ তাদের একজন বা উভয়েই জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের ‘উফ’ বল না, তাদের ধমক দিও না, তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বল। (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩)।
পড়াশোনায় ভালো হলে ভালো রেজাল্ট করা যায়, ভালো চাকরি পাওয়া যায়। কিন্তু ভালো মানুষ হতে হলে প্রয়োজন মানবিক গুণ, অন্যের কষ্ট উপলব্ধি করার নিখাদ সুন্দর মন। আর তা যদি না থাকে তবে শিক্ষার মর্মার্থ বা উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হয়। তাই তরুণদের সবার আগে বাবা-মাকে সম্মান করতে হবে, তাদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
মনে রাখা প্রয়োজন, কালের বিবর্তনে আজ যারা তরুণ-তরুণী তারাও একসময় বার্ধক্যে উপনীত হব। আমাদের সঙ্গে বৃদ্ধাবস্থায় সেই আচরণ করা হবে, যে আচরণ আমরা আমাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে করব। অন্তত এ দিকটি বিবেচনায় রেখে আমাদের উচিত বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচরণ করা। শুধু বড় বড় ডিগ্রি ও সার্টিফিকেটের জন্য শিক্ষা নয়। ভালো মানুষ ও সুসন্তান হিসেবে নিজেকে বিকশিত করতে হবে। যারা আজ তরুণ, ভবিষ্যতে বাবা হবে, তারা যেন সত্যিকার অর্থেই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়, মানবিক গুণ ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন মানুষ হয়, ছোটবেলায় বাবা-মা যেমন তাদের অনেক স্নেহ-ভালোবাসা, আদরযতেœ মানুষ করেছেন, বৃদ্ধ বয়সে তারা যেন সন্তানের কাছ থেকে তেমনি আদরযতœ ও প্রাপ্য সম্মান পান, সে প্রত্যাশায় লেখা শেষ করলাম।