শাহজাহান আলী বিপাশ
কেউ লাগিয়েছেন বারোমাসি টমেটো, কেউ পেঁপে, কেউ বেগুন আবার কেউ বা লাগিয়েছেন লাউ, পেয়ারা, শিম। আর এ সব সবজি শতভাগ জৈবপদ্ধতি এবং নিরাপদ। ব্যবহার করা হয়নি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। দামও পাচ্ছেন বেশি এইসব কৃষকরা। বাজারে নিয়ে যাবার সাথে সাথে এ সবজিগুলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সবার আগে। কোনো কোনোে জমি থেকেই ভোক্তারা সবজি প্যাকেট ভরে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ১২টি গ্রামে প্রায় ৩শ জন কৃষক ১৮২ বিঘা জমিতে এসব নিরাপদ সবজি উৎপাদন করে আলোচনায় এসেছেন। আর কৃষকদের এ কাজে কারিগরিসহ সার্বিক সহযোগিতা করছে বিকশিত বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। খুব শিগগিরই কৃষকদের উৎপাদিত নিরাপদ সবজিগুলো দেশের বাজার ছাড়িয়ে বিদেশে রপ্তানির আশা করছে তারা।
গত ৬ মাস ধরে কালীগঞ্জ উপজেলার ১২টি গ্রামে ১২জন মডেল চাষিসহ প্রায় ৩শ জন চাষি তারা নিজেদের জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন করছে শতভাগ জৈব পদ্ধতিতে। এর মধ্যে মডেল বা প্রদর্শনী প্লটে উপজেলার লুচিয়া গ্রামে ৩৩ শতক জমিতে ইশারত আলী মন্ডল বাধাকপি, জগন্নাথপুর গ্রামে ৩৩ শতক জমিতে মাহমুদুল হাসান ফুলকপি, বাদুরগাছা গ্রামে ৩৩ শত জমিতে ওলিয়ার রহমান শিম, ষাটবাড়িয়া গ্রামের ৩৩ শতক জমিতে সাখাওয়াত লিটন শশা, বেথুলি গ্রামে গোলাম রহমান ৩৩ শত জমিতে বেগুন, বনখিদ্দা গ্রামের নজরুল ইসলাম পলিথিন পদ্ধতিতে ৩৩ শতক জমিতে বেগুন, মোস্তবাপুর গ্রামে মনোয়ারা বেগম বেগুন ও পান, ঘোষনগর গ্রামের আব্দুর রশিদ ৩৩ শতক জমিতে হাজারী লাউ, ইশ্বরবা গ্রামের জয়নাল আবেদিন ৩৩ শতক জমিতে শাহী পেঁপে, মাহামুদপুর গ্রামের হারুন অর রশিদ ৩৩ শতক জমিতে থাই পেয়ারা, কুল্লাপাড়া গ্রামের নিখিল কুমার ৩৩ শত জমিতে বারোমাসি টমেটো,আগমুন্দিয়া গ্রামে ৩৩ শতক জমিতে আনোয়ারুল ইসলাম বেগুন চাষ করছেন। এছাড়া উপজেলার প্রায় ৩শ চাষি ১৮২ বিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করছে।
বনখিদ্দা গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম জানান, তিনি কীটনাশক বাদে বেগুন চাষ করছেন। তার বেগুনের সাইজও অনেক বড়। ২টি বেগুন এক কেজি সাইজ। ৩৫-৪০টাকা দরে বেগুন বিক্রি করছেন। তিনি আরও বলেন, পলিথিন পদ্ধতিতে বেগুন চাষ করে সফল হয়েছেন। পলিথিন পদ্ধতিতে ঝিনাইদহে কেউ বেগুন চাষ করেনি এখনও। আমি হয়তো প্রথম। বেগুন গাছে আসার পর পর যদি পলিথিন ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তাহলে এর সাইজ অনেক ভাল হয় এবং কোনো পোকা এটিকে আক্রমণ করতে পারে না।
উপজেলার কুল্লাপাড়া গ্রামের কৃষক নিখিল কুমার জানান, তিনি তার জমিতে জৈব পদ্ধতিতে বারোমাসি (বারী-৪) জাতের টমেটো চাষ করছেন। সারা বছর এই টমেটো উৎপাদন হয়। প্রতি কেজি টমেটো ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি করছেন। তিনি জানান, তার টমেটোতে তিনি কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না। ফল পাকার আগেই তার জমি থেকে লোকজন টমেটো ক্রয় করে নিয়ে যায়।
জগন্নাথপুর কৃষক মাহমুদুল হাসান জানান ৩৩ শতক জমিতে ফুলকপি চাষ করেছেন। বাজারে বিষযুক্ত ফুলকপির চেয়ে আরও বেশি ভাল ফুলকপি তিনি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন জৈব পদ্ধতিতে। প্রতিটি ফুলকপির সাইজ হয়েছে প্রায় ৫০০ গ্রাম করে। প্রতি কেজি ফুলকপি ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, তার ধারণাই ছিল না রাসায়নিক সার বাদে ভালো ফসল উৎপাদন করা যায়। তিনি বলেন, এখন থেকে তিনি জৈবপদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করবেন।
বিকশিত ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম টিটো জানান, তারা কালীগঞ্জ উপজেলার ১২টি গ্রামে ২৫ জন করে চাষি নিয়ে একটি করে গ্রুপ তৈরি করেছেন। সব মিলিয়ে ১২টি গ্রামে একটি করে কৃষক গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। আর প্রতিটি গ্রুপে ২৫ জন করে সদস্য। একজন করে লিড ফার্মার রয়েছে। যারা প্রদশনীয় প্লটের ৩৩ শত জমিতে সবজি উৎপাদন করে। আর বাকিরা যতটুকু করতে পারে। তিনি বলেন, আমরা যে সকল সবজি খাই সবগুলো বিষে ভরা। প্রতিনিয়মত বিষযুক্ত সবজি খেয়ে আমরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। বিকশিত ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অর্থায়নে এবং কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার্বিক সহযোগিতায় এ কাজটি করছেন।
তিনি বলেন, কৃষকদের বিঘা প্রতি ১শ কেজি কম্পোষ্ট সার, ১২টি পোকা দমনে ফেরোমন ট্রাপ, ফসল বা সবজি বাজারজাত করণের জন্য প্লাস্টিকের ক্যারেট, ফসল বা সবজি জমি থেকে উঠানোর জন্য চট-ত্রিপল প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও নিয়মিত ওই সকল কৃষকদের কৃষি অফিসের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। আনোয়ারুল ইসলাম টিটো জানান, বর্তমানে কৃষকদের উৎপাদিত সবজি উপজেলায় বিক্রি হচ্ছে। তবে আলোচনা চলছে নিরাপদ এ সবজিগুলো খুব শিঘ্রই এফএও’র সহযোগিতায় বিদেশে রপ্তানি করা হবে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ জাহিদুল করিম জানান, সত্যিই গর্বের বিষয় ঝিনাইদহে কালীগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ৩শ জন কৃষক একযোগে নিরাপদ খাদ্যে বা সবজি উৎপাদন করছে। কৃষি অধিদপ্তর নিয়মিত এসকল কৃষকদের সাথে যোগাযোগ রাখছে। তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন। তিনি বলেন, মানুষ এখন বিষমুক্ত সবজি পেতে চাই। উপজেলায় প্রায় ১৮২ বিঘা জমিতে যে সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে তা নিরাপদ ও জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত হচ্ছে। তিনি এ জন্য বিকশিত বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ও নিরাপদ সবজি উৎপাদনের সাথে জড়িত কৃষকদের ধন্যবাদ জানান।