ঝিনাইদহের ঐতিহাসিক শিব মন্দিরটি হতে পারে টু্রিষ্ট স্পট
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার জামাল ইউনিয়নের তৈলকূপী গ্রামে বেগবতী নদীর তীরে অযতœ আর অবহেলাই এখনও গাছপালা মাথায় নিয়ে মাথা উচুঁ করে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে রাজার আমলের ঐতিহাসিক শিব মন্দিরটি। শিব মন্দিরের নামে ২০ শতক জমি থাকলেও নেই তার কোন সিমানা।
সরজমিনে যেয়ে দেখা যায় স্থানীয়রা মন্দিরের চারিদিকে লাগিয়েছে মেহগনি গাছ সহ অন্যান্য গাছ। মন্দির কমিটির সাধারন সম্পাদক তৈলকূপী গ্রামের জগনাথ সরকার জানান এর আগে এক বার জেলা পরিষদ থেকে কিছু বরাদ্ধ ৫০ হাজার টাকা এবং বহুদিন পর উপজেলা পরিষদ থেকে ২ টন চাউল আসছিলো তা দিয়ে মন্দিরের নীচে চারদিকে কিছু ইট ক্রয় করে গোড়া গেথে দিয়েছিলাম এবং মন্দিরের পশ্চিম পাশে লোকজনের বসার জন্য ২ টা সিমেন্টর বেঞ্চ তৈরী করে দেওয়া হয়। এছাড়া মন্দিরের উল্লেখ করার মত কোন উন্নয়ন হয়নি। এখানে এখনও প্রতি বছর চৈত্র মানের শেষ দিনে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন চৈত্র পূজার বাজার নাম করে একটি বাজার বসায়। এ রেওয়াজ সেই রাজার আমল থেকে চলে আসছে। চৈত্র পূজার বাজারে দূর-দূরান্ত থেকে হিন্দু মুসলিম সবাই এসে এই উৎসবে যোগ দিয়ে উৎসব উপভোগ করেন।
এই ঐতিহাসিক শিব মন্দিরে এক সময় কান পাতলে শোনা যেত ঘোড়ার ছুটে চলার শব্দ। রাজা ছিল, রাজ্য রক্ষার জন্য ছিল সৈন্যবাহিনী। সেই রাজ্যও নেই, রাজাও নেই। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তৈলকূপী গ্রামের শিব মন্দিরসহ রাজার আমলের আরো আটটি মন্দির। নলডাঙ্গার মার বাড়ির মন্দিরগুলো মোটামুটি রক্ষনা বেক্ষন করা হলেও তৈলকূপী শিব মন্দিরটি পড়ে আছে অযতেœ অবহেলায়। এই মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটাও ঠিকমত বোঝা মুশকিল। এলাকার ঐতিহাসিক রাজবংশের প্রতিষ্ঠিত এসব মন্দিরের পাশে এখন ফসলের আবাদ হচ্ছে। মন্দিরগুলো অযতœ, অবহেলায় প্রাচীন গৌরব হারিয়েছে বহুদিন আগেই। তারপরও বছরের বিভিন্ন সময় ভ্রমণপিপাসু মানুষ ইতিহাসের ঐতিহ্য অনুসন্ধানে মন্দিরগুলো দেখতে আসতেন। কিন্তু বর্তমানে এর আশপাশে চাষাবাদ হওয়ার দর্শনার্থীদের আগমন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।
রাজবংশের ইতিহাস, ঐতিহ্য বিলিন হয়ে গেছে পাকিস্থান আমলেই। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, প্রায় পাঁচশ বছর আগে সুরী বিঞ্চুদাস হাজরা নলডাঙ্গায় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নবাবের চাকরি করে ‘হাজরা’ উপাধি পান। তার পিতার নাম ছিল মাধব শুভরাজ। তিনিও নবাবের চাকরি করতেন। বৃদ্ধ বয়সে বিঞ্চুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসী হন। এরপর তিনি ফরিদপুরের ভবরাসুর হতে নলডাঙ্গার খড়াসিং গ্রামে চলে আসেন এবং বেগবতী নদীর তীরে জঙ্গলে তপস্যা শুরু করেন।
১৫৯০ সালে মোগল সুবেদার মানসিংহ বাংলা বিজয়ের পর নৌকাযোগে বেগবতী নদী পথে রাজমহলে যাচ্ছিলেন। তার সৈন্যরা পথিমধ্যে রসদ সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানে বের হয়ে বিঞ্চুদাস সন্যাসী তপস্যারত দেখতে পান। এ সময় বিঞ্চুদাস সৈন্যদের খুব দ্রুত রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে মানসিংহ খুশি হয়ে সন্যাসীকে পাশ্ববর্তী পাঁচটি গ্রাম দান করেন। এই গ্রামগুলোর সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারি এবং ক্রমান্বয়ে তা নলডাঙ্গা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরপর প্রায় তিনশ বছর বিঞ্চুদাসের বংশধরেরা এই এলাকা শাসন করেন। ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দু ভূষণ যক্ষা রোগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তক পুত্র রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণদেব রায় রাজ্যের দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ভূষণদেব রায় কয়েকটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেগবতী নদীর তীরে। এর একটি হচ্ছে তৈলকূপী গ্রামের বেগবতী নদীর শশ্মান ঘাটের শিব মন্দির। প্রকৃতপক্ষে রাজা বাহাদুর প্রমথ ভূষণদেব রায় ছিলেন বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গুরুগোবিন্দ ঘোষালের কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি রাজ বংশের কেউ ছিলেন না। রাজা ইন্দু ভূষণ মারা যাওয়ার দীর্ঘ নয় বছর পর ১৮৭৯ সালে পূর্ণ জমিদারির ভার গ্রহণ করেন রাজা বাহাদুর প্রমথ ভূষণদেব রায় ।
১৯১৩ সালে তিনি ‘রাজা বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন। সে সময় তিনি শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হয়ে পিতা-মাতার নামে ইন্দুভূষণ ও মধূমতি বৃত্তি চালু করেন যা তখনকার সময়ে এক বিরল ঘটনা ছিল। তিনিই ১৮৮২সালে রাজবাড়ির নিকট ‘নলডাঙ্গা ভূষণ হাই স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি এখন কালীগঞ্জে অবস্থিত। রাজা বাহাদুর প্রমথ ভূষণ দেব রায় ১৯৪১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের কাশিতে মারা যান। কুমার পন্নগ ভূষণ দেব রায় ও কুমার মৃগাংক ভূষণ দেব রায় নামে তার দুই পুত্র ছিল। ১৯৫৫ সালে এক সরকারি আদেশে অন্যান্য জমিদারির মতো এই জমিদারিও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং রাজবংশ শেষবারের মতো লোপ পায়। তারপর থেকেই মন্দিরের কোনো সংস্কার হয়নি। তবে গত ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে সরকারি বরাদ্দকৃত ৭৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয় শ্রী শ্রী লক্ষ্মীদেবী মন্দির উন্নয়নের জন্য এবং শিব মন্দির উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৬৫ হাজার টাকা।
এরপর স্থানীয় লোকজন নিজেদের টাকায় অন্যান্য মন্দির সংস্কার করে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত পুনরায় কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে স্থানীরা জানান, স্থানটিতে আগে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটতো। সংস্কার আর যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকায় এখন দর্শনার্থীরা আসছেন না। দক্ষিণ পাশে বেগবতী নদীর উপর একটি ব্রীজ নির্মাণ হলে পার্শবর্তী কয়েকটি গ্রামের লোকজন সহজেই আসতে পারতো। দেশের প্রতœতত্ত্ব বিভাগ অতি প্রাচীন এই ইতিহাস আর ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে এলে মন্দিরগুলো হতে পারতো এক অমূল্য সম্পদ।
স্থানীয়রা জানান, তৈলকূপী গ্রামের এই শিব মন্দিরটি যদি রক্ষনা-বেক্ষন করা যায় তাহলে এটিও একটি দর্শনীয় স্থান হতে পারে। মন্দিরে সহজে যাওয়ার রাস্তা না থাকায় এখানে ভ্রমন পিপাসুরা এই স্থানটি চিনলেও আসতে পারেন না। কালীগঞ্জ থেকে এটা একবারেই নিকটে যদি গুঞ্জনগর শশ্মান ঘাট এবং তৈলকূপী শ্মসান ঘাটে বেগবতী নদীর উপর একটি সেতু হয়। এ জন্য এলাকার সাধারন মানুষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ঝিনাইদহ জেলার সু-যোগ্য জেলা প্রশাসকের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন।