শুক্রবার সূরা কাহফ তেলাওয়াতের রহস্য
আমাদের প্রিয়নবী (সা.) একাধিক হাদিসে পবিত্র কোরআনের ১৮তম সূরা তথা ‘আল কাহফ’ এর ফজিলত বর্ণনা করেছেন। আবুদ দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত (ভিন্ন বর্ণনামতে, শেষ ১০ আয়াত) মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (মুসলিম : ১৭৬৬)।
এ হাদিসে সাধারণভাবে সূরা কাহফের একটি নির্ধারিত পরিমাণ আয়াত মুখস্থ ও তেলাওয়াত করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বর্ণনার ক্ষেত্রে ‘প্রথম’ ও ‘শেষ’ দুটি শব্দই বিবৃত হয়েছে। এজন্য কোনো কোনো হাদিসবিদের বক্তব্য হলোÑ সূরার শুরু ও শেষ উভয় দিক থেকে দশ দশ আয়াত মুখস্থ করে নেওয়াটাই সতর্কতা। অন্যদিকে আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেনÑ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমাবার সূরা কাহফ তেলাওয়াত করবে আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তির জন্য এ জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত বিশেষ এক নূর (হেদায়েত ও নিরাপত্তার আলো) দান করবেন।’ (মুসতাদরাকে হাকিম : ২/৩৯৯)। উল্লেখ্য, এ মর্মে একাধিক সূত্রে হাদিসের বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণনা পাওয়া যায়। বস্তুত এসব হাদিস থেকে বিশেষ করে জুমাবার সূরা কাহফ তেলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফজিলত প্রমাণিত হচ্ছে।
পূর্বসূরিদের কাহফের আমল
এ বিষয়ক হাদিসগুলো সামনে রেখে যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহ প্রতি শুক্রবার সূরা কাহফ তেলাওয়াতের আমল করে আসছে। সাহাবা ও তাবেঈন থেকে শুরু করে আমাদের মহান পূর্বসূরি মনীষীদের জীবনীতে এ সম্পর্কিত রকমারি তথ্য পাওয়া যায়। ইমাম আহমাদ (রহ.) প্রতি শুক্রবার সূরা কাহফ তেলাওয়াত করতেন। কখনও ঘরে তেলাওয়াত করতে না পারলে মসজিদে যাওয়ার পথে পড়ে নিতেন। (আল মুগনি; ইবনে কুদামা : ২/৬১০)।
বর্তমান সময়ে আমরা যাতায়াতের পথে ল্যাপটপ, ট্যাবলেট কিংবা মোবাইল থেকেও তেলাওয়াত করে নিতে পারি। নিকট অতীতের বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) নিজের সম্পর্কে বলেন, আমাদের পারিবারিক ধর্মীয় অনুশীলনের গৌরবময় ঐতিহ্যের বদৌলতে ছোটবেলা থেকেই জুমাবার সূরা কাহফ তেলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে ওঠে। (দিরাসাতুন কোরআনিয়াহ : পৃ. ১৪৮, দারু ইবনে কাসির, দামেস্ক)। নদভি (রহ.) পরবর্তী সময়ে এ সূরা নিয়ে বিশেষ চিন্তা ও গবেষণার প্রয়াস পান। তাফসির, হাদিস ও ইতিহাসবিষয়ক প্রচুর গ্রন্থ অধ্যয়নের সারনির্যাস এবং নিজের গবেষণার ফলাফল স্বরূপ তিনি এ সম্পর্কে ‘তাআম্মুলাত ফি সূরাতিল কাহফ’ নামে চমৎকার একটি বই রচনা করেন। বইটি মিশর থেকে প্রকাশিত হয় এবং বিদ্বান মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।
দুর্লভ ব্যাপার হলো, রমজানের যেই জুমাবার নদভি (রহ.) এর ইন্তেকাল হয়, সে দিনও তিনি রীতিমতো জুমার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং সূরা কাহফ তেলাওয়াত করতে বসেন। কিন্তু দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা হেতু সূরা কাহফের স্থলে সূরা ইয়াসিন সামনে চলে আসে। সূরা ইয়াসিন পড়তে শুরু করেন এবং পড়তে পড়তে এ আয়াতে এসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেনÑ ‘আপনি শুধু তাদেরই সতর্ক করতে পারেন, যারা উপদেশ অনুসরণ করে এবং দয়াময় আল্লাহকে না দেখে ভয় করে। অতএব আপনি তাদের সুসংবাদ দিয়ে দিন ক্ষমা ও সম্মানজনক পুরস্কারের।’ (সূরা ইয়াসিন : ১১)।
সূরা কাহফের সঙ্গে দাজ্জালের ফেতনা যোগসূত্র
এ সূরার সঙ্গে দাজ্জালের ফেতনার কী যোগসূত্র যে, এটি পাঠ করলে নিরাপদ থাকা যাবে? বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে, পবিত্র কোরআনের এ সূরায় আল্লাহ তায়ালা চারটি ঘটনা উল্লেখ করেছেনÑ
আসহাবে কাহফের ঘটনা : এটি ওই সাত যুবকের ঘটনা, যারা এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন এবং শিরক থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিলেন। তাদের দেশের বাদশাহ ও সাধারণ লোকজন মূর্তিপূজা করত এবং অন্যদের উৎসাহিত করত। এমন নাজুক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সেই সাত যুবক নিজেদের দ্বীন ও ঈমান রক্ষার্থে আল্লাহর একত্ববাদ বুকে ধারণ করে দেশত্যাগ করেন এবং একটি গুহায় আশ্রয় নেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর দয়া করেন, তাদের সাহায্য করেন। একটি নির্দিষ্ট সময় পর আল্লাহর হুকুমে তারা ফের ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং শহরের লোকজনকে ঈমানদার হিসেবে দেখতে পান। বস্তুত এটি ছিল ঈমানের পরীক্ষা।
বাগানওয়ালার ঘটনা : আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে এক ব্যক্তিকে প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ দুটি বাগান দান করেছিলেন। কিন্তু লোকটি সময়ের ব্যবধানে আল্লাহর শোকর আদায় থেকে বিরত থাকে এবং নিজেকে অকৃতজ্ঞ প্রমাণ করে। এমনকি মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। লোকটিকে তার এক বন্ধু নসিহত করলেও সে তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি। ফলে আল্লাহ তায়ালা তার বাগানদ্বয় ধ্বংস করে দেন। বস্তুত এটি ছিল ধনসম্পদের পরীক্ষা।
মুসা (আ.) ও খিজির (আ.) এর ভ্রমণ : মুসা (আ.) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘এই পৃথিবীতে সবচেয়ে জ্ঞানী কে?’ প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি’। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ.) কে জানিয়ে দিলেন, অমুক জায়গায় তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী একজন ব্যক্তি রয়েছেন। অতঃপর মুসা (আ.) খিজির (আ.) এর সঙ্গে ভ্রমণ করলেন। তিনি শিখলেন, যেসব বিষয়কে আমরা অন্য চোখে দেখি আল্লাহর ইচ্ছায় সেখানেও ঐশীজ্ঞান লুকায়িত থাকতে পারে। বস্তুত এটা ছিল জ্ঞান দানের মাধ্যমে পরীক্ষা।
জুলকারনাইনের কাহিনি : জুলকারনাইন একজন বিশ্বাসী বাদশাহ ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে জ্ঞান ও ক্ষমতা দান করেছিলেন। মানুষকে সাহায্য করা এবং কল্যাণ ছড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে তিনি পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত দুনিয়াজোড়া অভিযান চালিয়েছিলেন। আল্লাহর অনুগ্রহে তিনি তামা ও লোহার মিশ্রণে এক সুবিশাল প্রাচীর তৈরির মাধ্যমে ইয়াজুজ-মাজুজের সমস্যা সমাধানে সমর্থ হয়েছিলেন। বস্তুত তা ছিল শক্তি ও ক্ষমতার পরীক্ষা।
তাফসিরবিদরা বলেন, মূলত কেয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে দাজ্জালও এ রকম চারটি পরীক্ষা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবেÑ
১. সে লোকদের এক আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে তার উপাসনা করতে আহ্বান করবে। ঈমান ও বিশ্বাসের পরীক্ষা।
২. দাজ্জালকে বৃষ্টি বর্ষণ ও বন্ধের ক্ষমতা প্রদান করা হবে। আর সে তার সম্পদ দ্বারা মানুষকে প্রলোভিত করবে। সম্পদের পরীক্ষা।
৩. দাজ্জাল আশ্চর্য সব খবর দেবে এবং জ্ঞানের কথা বলে মানুষকে প্রতারিত করবে। জ্ঞানের পরীক্ষা।
৪. দাজ্জাল পৃথিবীর অনেক অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তার ক্ষমতার দাপট দেখাবে। ক্ষমতার পরীক্ষা।