ধর্ম ও জীবন

আল্লাহ ও তাঁর নবীর মায়া-মমতা

ছেলে ইবরাহিমের অন্তিম অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কাছে যান। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দুই চোখ বেয়ে অশ্রু নামতে শুরু করে। এ দেখে আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও কি কাঁদেন? নবী (সা.) বললেন, ‘হে ইবনে আউফ, এটি হলো রহমত।’ অতঃপর তিনি বলেন, ‘নয়ন অশ্রুসিক্ত, হৃদয় ব্যথিত, তবে আমরা শুধু তাই বলব যাতে আল্লাহ খুশি হন। তোমার বিচ্ছেদে আমরা বড় কাতর হে ইবরাহিম।’

রহমত বা মায়া-মমতা আমাদের মহান প্রভুর অন্যতম গুণ। মহান প্রভু এটি নিজের জন্য অবধারিত করে নিয়েছেন। সবকিছুকে তাঁর দয়া বেষ্টন করেছে। প্রত্যেক প্রাণকে তা অন্তর্ভুক্ত করেছে। তিনি রহমান ও রহিম। পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু। তিনি আরহামুর রাহিমিন। দয়ালুদের দয়ালু। দিনরাত তাঁর হাত প্রসারিত। নিজ বান্দাদের ওপর অবিরত নেয়ামতরাশি বর্ষণ করেন। অনুদান বন্ধের চেয়ে প্রদানই তাঁর প্রিয়। তাঁর রহমত তাঁর ক্রোধকে ছেয়ে গেছে। বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ যখন সৃষ্টিকর্ম সম্পন্ন করলেন, তাঁর আরশে লিখে দিলেন, ‘আমার রহমত আমার ক্রোধকে ছাড়িয়ে গেছে।’

আল্লাহর রহমতের নমুনা তাঁর সৃষ্টিরাজিতে প্রকাশ্য এবং তাঁর নিদর্শনগুলোতে প্রদীপ্ত। ‘তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্য রাত ও দিন করেছেন, যাতে তোমরা তাতে বিশ্রাম গ্রহণ করো, তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।’ (সূরা কাসাস : ৭৩)। তাঁর রহমতেরই নমুনা : ‘তাঁর নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি এই যে, তিনি সুসংবাদবাহী বায়ু প্রেরণ করেন, যাতে তিনি তাঁর অনুগ্রহ তোমাদের আস্বাদন করান।’ (সূরা রুম : ৪৬)। বৃষ্টি নামান এবং মৃত ভূমিকে জীবন দান করেন : ‘মানুষ নিরাশ হয়ে যাওয়ার পরে তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং স্বীয় রহমত ছড়িয়ে দেন। তিনিই কার্যনির্বাহী, প্রশংসিত।’ (সূরা শূরা : ২৮)।

আল্লাহ তায়ালার রহমতের আরেক নিদর্শনÑ তিনি মায়া-মমতা ছড়িয়ে দিয়েছেন সৃষ্টিজীবের পরস্পরের মাঝে। তারা একে অপরকে যে রহমত ও দয়া করে তা মূলত আরহামুর রাহিমিনের দয়ারই নগণ্য প্রকাশ। যেমন বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ রহমতকে ১০০ ভাগ করেছেন। তার মধ্যে নিরানব্বই ভাগ তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। আর পৃথিবীতে এক ভাগ অবতীর্ণ করেছেন। ওই এক ভাগের কারণেই সৃষ্টজগৎ একে অন্যের ওপর দয়া করে। এমনকি ঘোড়া তার বাচ্চার ওপর থেকে পা তুলে নেয় এই ভয়ে যে, সে ব্যথা পাবে।’

সন্তানের প্রতি গর্ভধারিণীর মায়ার চেয়েও বেশি আল্লাহর দয়া। এক অদ্ভুত দৃশ্যপটসহ ওমর (রা.) বিষয়টি তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সামনে বন্দিদের আনা হয়। (এক বন্দি মহিলার শিশু তার থেকে আলাদা হয়ে যায়। নবীজি দেখতে পানÑ) বন্দিনীটি পাগলের মতো তার শিশুটিকে খুঁজছে। মহিলাটি তার সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে বন্দিদের যে শিশুকেই দেখতে পায়, তাকেই বুকে জড়িয়ে ধরে এবং স্তন্য দিতে শুরু করে। (বন্দিনী মহিলার) এ অবস্থা দেখে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের বললেন, আচ্ছা বল তো এ স্ত্রী লোকটি কি তার এ শিশুকে আগুনে নিক্ষেপ করতে পারে? তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! সাধ্য থাকতে কখনোই সে এটা হতে দেবে না! তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! এই মা তার শিশুর ওপর যতটা স্নেহশীল, আল্লাহ তাঁর বান্দার ওপর এর চেয়েও বেশি দয়াবান।’ (বোখারি ও মুসলিম)।

আল্লাহর করুণার আরেক নিদর্শনÑ তিনি প্রতি রাতে নিজ শান অনুযায়ী দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন প্রার্থনাকারী ও তওবা-ক্ষমাপ্রার্থীদের সম্মানার্থে। যেমন সর্বসম্মতভাবে এক হাদিসে নবী (সা.) বলেন, মহামহিম আল্লাহ তায়ালা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেন : ‘কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আছে এমন, যে আমার কাছে চাইবে? আমি তাকে তা দেব। কে আছে এমন, যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।’

তাঁর করুণা আরও উজ্জ্বলভাবে ফুটে ওঠে সীমালঙ্ঘনকারী ও তাওবাপ্রার্থীদের উদ্দেশে তাঁর হাত প্রসারিত করার মাধ্যমে। ‘বলুন, হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা জুমার : ৫৩)।
তাঁর মমতার আরেক নিদর্শনÑ তিনি আরশ বহনকারী ও এর আশপাশে নিজ প্রভুর পবিত্রতা ও প্রশংসায় নিয়োজিত ফেরেশতাদের নিযুক্ত করেছেন ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা ও সুপারিশ কামনায়। ‘যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করে, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মোমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আপনার রহমত ও জ্ঞান সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। অতএব, যারা তওবা করে এবং আপনার পথে চলে, তাদের ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন।

হে আমাদের পালনকর্তা, আর তাদের দাখিল করুন চিরকাল বসবাসের জান্নাতে, যার ওয়াদা আপনি তাদের দিয়েছেন এবং তাদের বাপ-দাদা, পতি-পতœী ও সন্তানদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করে তাদের। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। এবং আপনি তাদের অমঙ্গল থেকে রক্ষা করুন। আপনি যাকে সেদিন অমঙ্গল থেকে রক্ষা করবেন, তার প্রতি অনুগ্রহই করবেন। এটাই মহাসাফল্য।’ (সূরা গাফির : ৭-৯)।
জান্নাত আল্লাহর রহমতের আরেক নিদর্শন। নিজ রহমতের বদৌলতেই তিনি যাকে ইচ্ছে নিজ বান্দা থেকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। কেউ নিজের আমল দিয়ে জান্নাতে পৌঁছতে পারবে না। বান্দা যদি তার পক্ষে সম্ভব যাবতীয় প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ইবাদত নিয়েও হাজির হয়, তাতেও সে আল্লাহর ইবাদতের হক আদায় করতে পারেনি। পারেনি তাঁর প্রাপ্য শুকরিয়া আদায় করতে। বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কাউকে তার আমল জান্নাতে দাখিল করাতে পারবে না। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনাকেও না? তিনি বললেন, আমাকেও না। যতক্ষণ যাবত না আল্লাহ আমাকে তাঁর দয়া ও করুণায় আবৃত করে নেন।’

যে কেউ আদম-সন্তানদের নেতা মহানবী (সা.) এর জীবন পরিক্রমায় দৃষ্টি দেবে, তাঁর জীবন ও তাঁর শরিয়তকে দেখতে পাবে দয়ার পূর্ণাঙ্গ ও পূর্ণতর অবয়বে। মহানবী (সা.) ছোটদের স্নেহ করতেন; তাদের সঙ্গে কোমলতা দেখাতেন; তাদের চুমো দিতেন এবং তাদের সঙ্গে খেলতেন। তিনি বলেতেন, ‘যে দয়া করে না, তার প্রতি দয়া করা হয় না।’

বোখারিতে রয়েছে, ছেলে ইবরাহিমের অন্তিম অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কাছে যান। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দুই চোখ বেয়ে অশ্রু নামতে শুরু করে। এ দেখে আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও কি কাঁদেন? নবী (সা.) বললেন, ‘হে ইবনে আউফ, এটি হলো রহমত।’ অতঃপর তিনি বলেন, ‘নয়ন অশ্রুসিক্ত, হৃদয় ব্যথিত, তবে আমরা শুধু তাই বলব যাতে আল্লাহ খুশি হন। তোমার বিচ্ছেদে আমরা বড় কাতর হে ইবরাহিম।’ বস্তুত মানবতা কখনও রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে শিশুদের প্রতি কোমল কোনো মানুষ দেখেনি। তাঁর খাদেম আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে পরিবারের প্রতি কোমল কোনো মানুষ দেখিনি।’

নারীদের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দয়া ছিল আরও বেশি। মায়া ছিল আরও অধিক। তাদের হক আদায়ে তাঁর উপদেশ ছিল আরও জোরাল। তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন কন্যাদের প্রতি সদয় হতে। তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করতে। যেমন বোখারিতে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কন্যাদের (লালন-পালন, শিক্ষা ও বিয়ে দেওয়ার) দায়িত্ব পেল আর তাদের প্রতি তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করলÑ কেয়ামতের দিন এ মেয়েরা তার জন্য দোজখের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে (অর্থাৎ সে জান্নাতি হবে)।’

স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচার সম্পর্কে সুনানে তিরমিজিতে সহিহ সনদে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে নিজ স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে। আর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যবহারের দিক থেকে আমি তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) দুর্বল, সেবকদের প্রতি দয়া করতেন। তাদের বিষয়কে গুরুত্ব দিতেন। যেন তাদের ওপর জুলুম না হয়। তাদের প্রাপ্য অধিকার যাতে ক্ষুণœ না হয়। তিনি এমনকি দরিদ্র ও দুর্বলদের প্রতি দয়া ও ভালোবাসাকে রিজিক লাভ এবং শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। সুনানে আবু দাউদে সহিহ সনদে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা দুর্বলদের মাঝে আমাকে অন্বেষণ করো (তাদের মাঝে আমার সন্তুষ্টি তালাশ করো)। কেননা দুর্বলদের উসিলাতেই তোমাদের রিজিক প্রদান করা হয় এবং সাহায্য করা হয়।’

৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪০ হিজরি মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার
ভাষান্তর আলী হাসান তৈয়ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button