বায়েজিদ বোস্তামী ও আবুল হাসান খারাকানী
হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)। তাসাউফের ইতিহাসের যুগস্রষ্টা ওলি। পুরো নাম আবু ইয়াজিদ, বাবার নাম তাইফুর আর দাদার নাম সরুশান। হিজরি ১৩৬ থেকে ১৮৮’র মধ্যবর্তী সময়ে তার জন্ম। তবে ইন্তেকাল ২৬১ হিজরি সালে। বোস্তামী তার স্থানিক পরিচয়। ইরানের খোরাসান প্রদেশের শাহরুদ জেলার অন্তর্গত প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদ বোস্তাম। ইরানিরা বলে বাস্তাম। বোস্তামেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত। তার ও আবুল হাসান খারাকানীর মাজার জিয়ারতের ঘটনাবহুল স্মৃতি এ লেখকের মনের দর্পণে এখনও সমুজ্জ্বল।
সুলতানুল আরেফিন বায়েজিদ বোস্তামীর অলৌকিক শক্তি ও আধ্যাত্মিক সমুচ্চ মাকামের বর্ণনা রয়েছে শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহ.) প্রণীত তাযকিরাতুল আউলিয়ায়, মওলানা রুমির (রহ.) মসনবিতে ও আবদুর রহমান জামির (রহ.) নাফাহাতুল উন্স কিতাবে। তার জীবনের অবিস্মরণীয় ঘটনা আবুল হাসান খারাকানীর জন্মের ভবিষ্যদ্বাণী। সুলতান মাহমুদ গজনবি ১৭ বারের অভিযানে সোমনাথ মন্দির ও ভারত জয় করেছিলেন। এ বিজয়ের পশ্চাতে বিরাট ভূমিকা ছিল আবুল হাসান খারাকানীর দোয়ার। তিনি বাঘের পিঠে চড়ে বিষধর সাপ চাবুক বানিয়েছিলেন। এ ঘটনা উপরোক্ত মনীষীদের রচনায় ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।
আবুল হাসান খারাকানীর জন্মের প্রায় একশ বছর আগে বায়েজিদ বোস্তামী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, খারাকানে একজন আধ্যাত্মিক বাদশাহ আসবেন, তার নাম হবে আবুল হাসান। তার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, চালচলনের ধরন কীরূপ হবে, তাও উল্লেখ করেছিলেন সুলতানুল আউলিয়া।
রূযী আ’ন সুলতা’নে তাকওয়া মী গুযাশত
বা’ মুরীদা’ন জা’নেবে সাহরা’ ও দাশত
একদা সেই তাকওয়ার বাদশাহ যাচ্ছিলেন হেঁটে
মুরিদান বেষ্টিত প্রান্তরভূমি হয়ে গ্রামের পথে।
খারাকান শহরের উপকণ্ঠে এসে হঠাৎ থেমে গেলেন বায়েজিদ বোস্তামী। দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলেন। যেন বাতাসের শরীর থেকে সুবাস টেনে নিচ্ছেন। প্রেমিকের বাড়ির দিক থেকে প্রবাহিত মলয় সুবাসে বুঝি প্রাণ জুড়াচ্ছেন প্রেমের বাদশাহ বায়েজিদ। বায়েজিদের চোখে-মুখে কীসের যেন মত্ততা। দরদি এক মুরিদ মুর্শিদের বেহাল অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি এভাবে বড় বড় নিঃশ্বাসে দম নিচ্ছেন কীসের? মুরিদ ভাবে, কোনো সাধারণ সুগন্ধি হলে তা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের রাডারে ধরা পড়ত। ছয় দিকের বেষ্টনী এই যে পৃথিবী, তার মাঝের কিছু হলেও আঁচ করতে পারতাম আমরা। কিন্তু না। এই খোশবু অন্য দুনিয়ার, প্রেমের জগতের। যে জগৎ আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় ও ছয় দিকের বেষ্টনী পৃথিবীর বাইরের। সেই প্রেমের সুবাসেই সমগ্র জগৎ, লৌহ কলম, মাতোয়ারা। বায়েজিদও বুঝি সেই প্রেমে আত্মহারা।
হজরত ইয়াকুব (আ.) এর প্রাণপ্রিয় ছেলে ইউসুফ হারিয়ে গিয়েছিল সৎভাইদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে মিশরের দাসবাজারে নিলামে বিক্রি হয় ইউসুফ। মিশরপতি আজিজ মিসির তাকে খরিদ করে নিয়ে যান ছেলের আদরে। কিন্তু আজিজ মিসিরের স্ত্রী জুলাইখা প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে ইউসুফের প্রতি। জুলায়খার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কারারুদ্ধ হন ইউসুফ।
দীর্ঘ ৭ বছর কারাগারে কাটানোর পর আজিজের এক স্বপ্ন সূত্রে তিনি মুক্ত হন এবং প্রথমে অর্থমন্ত্রী ও আজিজের মৃত্যুর পর মিশরের অধিপতি হন। এদিকে বাবা ইয়াকুব পুত্র শোকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে যান। শোকের সেই দিনগুলোতে আজকের ফিলিস্তিনে বসে ইয়াকুব (আ.) মিশর থেকে ইউসুফের খোশবু পেয়ে বলে উঠেন ‘তোমরা যদি আমাকে অপ্রকৃতিস্থ মনে না করো তাহলে বলি, আমি ইউসুফের ঘ্রাণ পাচ্ছি।’ (সূরা ইউসুফ : ৯৪)। ইউসুফের জামা এনে ইয়াকুবের চোখে-মুখে রাখা হলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। কোরআনে বর্ণিত হজরত ইয়াকুব (আ.) এর ঘটনার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় বায়েজিদ বোস্তামীর সুগন্ধের শ্বাস টানার। আমাদের প্রিয়নবীর জীবনেও ঘটেছে এমন ঘটনা। বায়েজিদ বোস্তামী কৌতূহলী মুরিদকে বুঝিয়ে বললেন,
গোফত বুয়ে বুল আজব আমদ বে মন
হামচুনা’নকে মর নবী রা’ আয ইয়ামান
বললেন, আশ্চর্য এক সুগন্ধি আসে আমার কাছে
নবীজির কাছে এসেছে যে খোশবু ইয়েমেন থেকে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেনÑ ‘আমি ইয়েমেনের দিক থেকে রহমান দয়াময় আল্লাহর সুবাস পাচ্ছি।’ সেই সুবাস ওয়াইস করনির। ওয়াইস করনি আল্লাহ ও রাসুলের মহব্বতে নিজের কাল্পনিক অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে আত্মহারা হয়েছিলেন। সেই মহব্বতে মাটির দেহসত্তা বিলুপ্ত হয়ে আত্মিক সত্তায় রূপান্তরিত ও সম্পূর্ণ আল্লাহর হয়ে যান। তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় অসহায় বৃদ্ধা মায়ের খেদমতের কারণে নবীজির দরবারে গিয়ে সাহাবির মর্যাদা পাননি; তবে নবীজির মহব্বতে তার হৃদয় আপ্লুত ছিল। ফলে স্বয়ং আল্লাহর নবী বলেছেন, আমি ইয়েমেনের দিক থেকে দয়াবান রহমান আল্লাহর সুবাস পাচ্ছি।
মানুষের স্বভাব চরিত্র পরিবর্তিত হয়ে যখন আল্লাহর পছন্দনীয় স্বভাবে রূপান্তরিত হয়, যখন আল্লাহ ও রাসুলের মহব্বতের আয়নায় দিল উদ্ভাসিত হয়, তখন বান্দার মাঝে খোদায়ি চরিত্র সুষমা বিস্তার লাভ করে। যেমন হাদিসে বলা হয়েছেÑ তাখাল্লাকু বিআখলাকিল্লাহÑ তোমরা আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও। সেই চরিত্রে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন ওয়াইস করনি। বায়েজিদ বললেন, আল্লাহর রাসুল যেভাবে ওয়াইস করনির কাছ থেকে রহমানি সুবাস পেয়েছিলেন আমিও সেরূপ সুবাস পাচ্ছি এমন এক বাদশাহর, যে আমার বহু বছর পরে আসবে খারাকান জনপদে।
আয পসে আ’ন সা’লহা’ আমদ পদীদ
বুল হাসান বা’দে ওফাতে বাযেযিদ
এই ঘটনার বহু বছর পর সেই বাদশাহর হলো আগমন
বায়েজিদের ইন্তেকাল শেষে এলেন শায়খ আবুল হাসান।
বায়েজিদ বোস্তামীর ইন্তেকাল হয় ২৬১ হিজরি সালে। আবুল হাসান খারাকানী জন্মগ্রহণ করেন ৩৪৮ বা ৩৫২ সালে। এ হিসাবে বায়েজিদ বোস্তামীর ইন্তেকাল আর আবুল হাসান খারাকানীর জন্মের মাঝখানে ব্যবধান ছিল প্রায় এক শতাব্দী। আবুল হাসান খারাকানী নাম ও পরিচয় সম্পর্কে বায়েজিদের মন্তব্যগুলো লোক সমাজে মুখে মুখে চালু ছিল। আবুল হাসান বড় হয়ে সেসব বর্ণনা শুনে এবং স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হয়ে অলক্ষে বায়েজিদের মুরিদ হয়ে যান। বর্ণিত আছে, প্রতিদিন ফজর বাদ আবুল হাসান চলে যেতেন ২৪ কিলোমিটার দূরত্বে বোস্তামে বায়েজিদের কবরের কাছে। দুপুর নাগাদ ব্যস্ত থাকতেন নানা সাধনায়। বায়েজিদের ফয়েজ লাভে ধন্য হতো তার মন ও জীবন। একবার ভোরে এসে দেখেন শীতকালে বরফের স্তূপে ঢেকে গেছে কবর। দিশা পান না কোন দিকে যাবেন। হঠাৎ আওয়াজ শুনতে পান কবরের দিক থেকে। আবুল হাসান! এসো এদিকে আমার কাছে। দুনিয়া বরফে ঢাকা তাতে কী আছে। এই ডাক শুনে অবর্ণনীয় রুহানি চেতনায় উদ্বেলিত হন আবুল হাসান।
লেখা শেষ করার আগে একটি স্মৃতিচারণের লোভ সংবরণ করতে পারছি না। বইয়ের পাতায় বর্ণনা পড়ে ১৯৮৯ এর কোনো একসময়ে তেহরান থেকে শাহরুদ পৌঁছলাম গভীর রাতে। ফজরের পর জিয়ারতে গেলাম ৬ কিলোমিটার দূরে বোস্তামে।
উন্মুক্ত উঠানে লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা বায়েজিদ বোস্তামীর কবরটি দেখে মনে হলো অবহেলিত। সালাম, দোয়াকালাম পড়লাম বিনম্র শ্রদ্ধায়। সকালের নাশতার জন্য যাচ্ছিলাম গ্রামের চায়ের দোকানের মতো একটি দোকানে। পথ আগলে মাঝ বয়েসি শ্মশ্রুধারী এক লোক সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আয কুজা আমাদিÑ কোত্থেকে এসেছ? বললাম, আয বাংলাদেশÑ বাংলাদেশ থেকে। বরায়ে জিয়ারতে বায়েজিদ আমদিÑ বায়েজিদের জিয়ারতের জন্য এসেছ। বললাম, বালেÑ হ্যাঁ। জানতে চাইলেন, চিল্লাখানা রফতি। চিল্লাখানায় প্রবেশ করেছ? জানতে চাইলাম চিল্লাখানা কী, কোথায়। তিনি বললেন, চিল্লাখানায় বায়েজিদ দিনের পর দিন ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তার কবরের শিয়রের পাশে আছে। তবে তালা দেওয়া, সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। বাংলাদেশ থেকে এসেছ, এ কথা বললে মোতাওয়াল্লি খুলে দেবে। মোতাওয়াল্লি পাশের মাজার বসে। শুনে মনটা পুলকিত হলো। এখন আফসোস হয়, সেদিন কেন লোকটির পরিচয় জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।
নাশতা সেরে মোতাওয়াল্লিকে বললাম, বাংলাদেশি। সঙ্গের তাবিজটা দেখালাম। তাবিজ মানে রেডিও তেহরানের বহির্বিশ্ব সম্প্রচারে বাংলা অনুষ্ঠানের সাংবাদিকের কার্ড। মোতাওয়াল্লি চুপিচুপি বললেন, এখন সরকারি টেলিভিশনের লোকজন এসেছে ‘ফিল্ম বরদারি’র জন্য। চিল্লাখানার ভেতরের ছবি তোলা নিষেধ। এখন খুললে অসুবিধা হবে। ওরা চলে যাওয়ার পর তুমি এসো। ভদ্রলোক কথা রাখলেন, চিল্লাখানায় ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন আমার বের হওয়ার অপেক্ষায়।
খারাকান যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম বাসস্ট্যান্ডে। আরেক মাঝ বয়েসি ভদ্রলোক গায়ে পড়ে কথা বললেন। পরিচয় নিয়ে তিনি বললেন, তুমি তো ইরান দেখেছ চারিদিকে মরুভূমি। কিন্তু এই বোস্তাম দেখ কেমন সুজলা-সুফলা। বললাম, আমাদের দেশও এ রকম চির সবুজের। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, বাস্তামের এ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সমৃদ্ধির কারণ কি তুমি জান? বললাম, না। তিনি বললেন, প্রচ- শীতকালের রাত। মা বায়েজিদের কাছে খাবার পানি চেয়েছিলেন। বরফের আস্তরণ ঠেলে খাবার পানি এনে বায়েজিদ দেখে মা ঘুমিয়ে পড়েছে। বায়েজিদ কীভাবে মায়ের ঘুম ভাঙবে। মা যদি রাতে ঘুম ভেঙে পানি চায়, কে গ্লাসটি তার হাতে তুলে দেবে। এই চিন্তায় ভোর অবধি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বায়েজিদ। ভোর রাতে চোখ মেলে দেখে পানির পাত্র হাতে কলিজার টুকরা দাঁড়িয়ে আছে। তখনই দুহাত তুলে প্রাণ খুলে দোয়া করলেন ছেলের দুনিয়া আখেরাত যেন সুজলা-সুফলা হয়। সেই দোয়ার ফল দেখ এখনও বাস্তামের বন বীথিকায়, ফসলের মাঠে কীভাবে হাসে।
মওলানা রুমির মসনবি শরিফ