ধান আনতে গরুর গাড়ি নিয়ে মাঠে ঝিনাইদহের কৃষক
শিপলু জামান-
গরুর গাড়ির কোন মিছিল নয়,আবার বর্তমানে গরু গাড়িতে ধান বহন করা গাড়ি প্রায় বিলুপ্তির পথে পথে। খুব একটা দেখা মেলে না কৃষকদের ধান তুলতে গরুর গাড়ি। কিন্তু এমন টি দেখা মিলে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ এলাকায়। আমন ধান আনতে গরুর গাড়ি নিয়ে মাঠে যাচ্ছেন কৃষকরা। দেখতে অনেক সুন্দর রাগছে।
আমন কৃষকদের প্রধান ফসল ধরা হয়। কোন রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই কৃষকেরা চলতি আমন মৌসুমের শেষের দিক পার করছেন। ক্ষেতের পাকা ধান ইতোমধ্যে ঘরে তুলতে শুরু করেছেন। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠে যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে দৃশ্যমান হচ্ছে কৃষি শ্রমিক আর ধান পরিবহনের গরুর গাড়িসহ নানা রকমের ইঞ্জিন চালিত গাড়ি। অবস্থাটা এমন সকলেই যেন ধান আগে ঘরে তোলার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। শুধু মাঠেই নয় এখন গ্রামের প্রতিটি পরিবারের কৃষাণিদের মাঝেও বিরাজ করছে মাড়াই করা ধান ঘরে তোলার ব্যস্ততা।
এ বছর ক্ষেতে ধানও হয়েছে ভালো। ফলে গ্রামীন কৃষি পরিবারের সস্যদের অবিরাম হাড়ভাঙা পরিশ্রম হলেও কৃষক কৃষাণিদের মাঝে বইছে খুশির জোয়ার। তাদের ভাষ্য, পরিশ্রম আর ধারদেনার মাধ্যমে চাষ করে সোনার ধান ভালোভাবে ঘরে তুলতে পারছেন এ খুশিতে বাড়ি বাড়িতে চলছে যেন উৎসবের আমেজ।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, উপজেলাতে চলতি মৌসুমে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার হেক্টোর। কিন্তু চাষ হয়েছে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আমন চাষ হয়েছে।
উপজেলার একাধিক কৃষক জানান, গত বোরো মৌসুমে একদিকে কঠোর পরিশ্রম অন্যদিকে ধারদেনার মাধ্যমে চাষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা ঠিকমতো ধান ঘরে তুলতে পারেননি। সে সময়ে লাগাতর কয়েক দিনের দমকা হাওয়ার সঙ্গে বর্ষার পানিতে একাকার হয়ে ক্ষেতের পাকা ধান পঁচে গলে ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এ লোকসান কাটিয়ে উঠতে চলতি আমন মৌসুমে কৃষকেরা কোমর বেধে লেগেছিল। তাদের সে পরিশ্রম আমনে সফল হয়েছে। কেননা অনেক কৃষক ইতোমধ্যে তাদের আমন ধান মাড়াই করে ঘরে তুলেছেন। এ সকল কৃষকেরা বলছেন প্রতিবিঘা জমিতে ২৫ থেকে ২৮ মন করে ধানের ফলন হচ্ছে। যা তাদের জন্য সন্তোষজনক ব্যাপার। কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিস বলছে, চলতি আমন মৌসুমে এ উপজেলাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ধান উৎপাদন হবে বলে তারা আশা করছেন।
কৃষক রেজাউল ইসলাম জানান, এ বছর প্রায় ১২ বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছিলেন। ইতোমধ্যে ৮ বিঘা ধান মাঠ থেকে বাড়ি এনেছেন। বাকিটা কাঁটা হয়েছে। আশা করছেন ২-৩ দিনের মধ্যে বাড়িতে আনতে পারবেন। এরপর ধান ঝাড়ার (মাড়াই করার) কাজ শুরু করবেন। তিনি বলেন,এ বছর ফলন ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে।
খেদাপাড়া গ্রামের কৃষক শিমুল ঘোষ জানান, এ উপজেলার মধ্যে তাদের গ্রামটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ধান উৎপাদন হয়। তিনি এ বছর ১৮ বিঘা জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন। এ পর্যন্ত অর্ধেকের বেশি জমির ধান বাড়িতে আনতে পেরেছেন। বাকি জমির ধান মাঠে কাঁটা রয়েছে। ভাড়ার গাড়ি পেলেই বাড়ি আনবেন। তিনি বলেন এখনও ধান মাড়াই করেননি। তাদের মাঠের প্রায় ৭০ ভাগ ধান কাঁটা হয়ে গেছে। কেউ কেউ মাড়াই করে ঘরেও তুলে ফেলেছেন। কৃষকদের মুখে শুনেছেন বিঘা প্রতি ২৪-২৫ মণ ধান হচ্ছে। তিনি বলেন, আমন ধানে খুব একটা খরচ নেই। কিন্তু মৌসুমের শেষের দিকে প্রয়োজনের সময় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ক্ষেতে একাধিক সেচ দিতে হয়েছে। সে কারণে উৎপাদন ব্যয় বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে তিনি জানান, এখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মাঠ থেকে ধান ঘরে আনতে ভোগান্তি কম হচ্ছে।বলরামপুর গ্রামের গাড়িয়াল সর্দ্দার আবদুস ছবুর জানান, তার নিজেরও মাঠে ধান রয়েছে। তারপরও নিজেদের ধান বাড়ি তুলে এখন এলাকার বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের মাঠের ধান বিঘাপ্রতি আড়াই হাজার টাকার চুক্তিতে গরুর গাড়িতে করে বাড়ি এনে দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, তারা মোট ১৬টি গাড়ি এক সঙ্গে মিলে এ কাজ করে প্রতিমৌসুমে বেশ পয়সা আয় করে থাকেন। তিনি বলেন, এ সময়টাতে পরিশ্রম হয় বেশি। কিন্তু অনেক মানুষ একসঙ্গে কাজ করার ফলে আনন্দের মধ্যদিয়ে সময় কেটে যায়।
এ সময়টাকে তারা উৎসবের সময় বলে মনে করেন।খড়িকাডাঙ্গা গ্রামেরকৃষাণি মমতাজ বেগম জানান, এখন চলছে ধান মাড়াইয়ের কাজ। বাড়ি বাড়িতে পরিবারের সকল সদস্যই এখন ধান ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত। তিনি বলেন, সময়টিতে গ্রামের কোন মানুষই এখন বসে নেই। সবাইকে করতে হচ্ছে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। তারপরও সবাই খুশি কারণ এ বছর ভালো ফলন হচ্ছে। তিনি বলেন, আমন ধানই গ্রা মাঞ্চালের মানুষের প্রধান ফসল। ফলে এটা ঘরে তোলার সময় ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় ঠিকমতো নাওয়া খাওয়া থাকে না পরিবারের সদস্যদের। তবে মাঠের এ সোনা ফলানো মানুষেরা বলছেন, কৃষক কৃষাণিদের শত ক্লান্তি আর পরিশ্রমের পরও এ সময়টিতে গ্রাম জুড়ে থাকে উৎসবের আমেজ।
এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, এ উপজেলাতে রেকর্ড পরিমাণে আমন ধানের চাষ হয়েছে। তার দাবি, এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ ভাগ ধান ইতোমধ্যে বাড়িতে চলে এসেছে। এ বছর আবহাওয়াও অনুকূলে রয়েছে। যারা মাড়াই করেছেন তারা বলছেন ফলন অন্য বছরের তুলনায় অনেক ভালো। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। যা দেশের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখবে।