ধর্ম ও জীবন

ওমর (রা.) ও রোমান দূতের আধ্যাত্মিক সংলাপ

আমিরুল মোমেনিন ওমর (রা.) রোমান দূতকে পাশে বসিয়ে অনেক কথা বলেন। তাদের এ সাক্ষাৎকার আর প্রশ্নোত্তর কূটনৈতিক বিষয়ে ছিল না; বরং তা ছিল সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক। মওলানা রুমির ভাষায় তিনি রোমান দূতের কাছে আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে অতি সূক্ষ্ম তত্ত্বকথা ব্যক্ত করেন আর আল্লাহ তায়ালা ওলি-আবদালদের যেসব আধ্যাত্মিক নেয়ামত দিয়ে ধন্য করেন, তার বর্ণনা দেন। হাল ও মাকামের মাহাত্ম্য এবং তাৎপর্য ব্যক্ত করেন।

আধ্যাত্মিক সাধনার পথে দুইটি অবস্থার নাম মাকাম ও হাল। ‘হাল’ অর্থ অবস্থা। আর ‘মাকাম’ মানে অবস্থান। সাধনার পথে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাধকের ইচ্ছা বা চেষ্টা ব্যতিরেকে আরোপিত হয় একটি অপার্থিব আলোকিত অবস্থা। এর নাম হাল। সেই হাল সাধককে আল্লাহর আকর্ষণ শক্তির মুঠোয় নিয়ে নেয়। কিন্তু সাধকের নফসানি বৈশিষ্ট্য যখন প্রকাশ পায়, তখন সেই হাল আস্তে করে উঠে চলে যায়। এর বিপরীত হলো মাকাম। মাকামে সাধকের এমন অবস্থা অর্জিত হয়, যাতে তার সামনে আধ্যাত্মিক জগৎটা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং এ অবস্থা ‘হাল’ এর মতো ক্ষণস্থায়ী হয় না বা তিরোহিত হয়ে যায় না; বরং স্থায়ী হয়ে থাকে। মাকাম সাধকের নিয়ন্ত্রণাধীন। সেখানেই তার অবস্থান। মওলানা বলেন; ‘হাল’ হলো সুন্দরী বধূর রূপের ঝলকের মতো, আর মাকামের তুলনা বধূর সঙ্গে নির্জনতায় অধিবাস। তিনি আরও বলেন, সুফিদের মাঝে আহলে হাল (হাল-ওয়ালা) আছেন অনেক; কিন্তু আহলে মাকাম গুটি কয়েক।

আমিরুল মোমেনিন দূতকে মানবাত্মার বিভিন্ন স্তর ও সফরের নানা মনজিলের রহস্য বর্ণনা করেন। কীভাবে রুহ ঊর্ধ্বজগৎ থেকে মানবদেহে প্রবেশ করল, কীভাবে জগতে আল্লাহর গুণাবলির নিত্যপ্রকাশ ঘটে, তার সবিস্তার বর্ণনা দেন। তাদের সংলাপের মূল বিষয়ের মধ্যে ছিল রুহ কীভাবে দেহের কায়ায় যুক্ত হয়? সৃষ্টিজগতে স্তরে স্তরে আল্লাহ তায়ালার তাজাল্লির উদ্ভাস কীভাবে হয়? সংশয় মানব মনে অশান্তি-অস্থিরতা আনে। নফসানি কামনা-বাসনা থেকে মুক্তি, মানুষকে সংশয় থেকে মুক্ত করে আর ঐশী রহস্যগুলো বোঝানোর যোগ্যতার অধিকারী করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি লাভের মাধ্যম বাতেনি কান। আর ওহি বলতে বোঝায়, মনের কানে রহস্যময় চেতনার উদ্ভাস। বাতেনি ইন্দ্রিয় বাহ্য পঞ্চেন্দ্রিয় থেকে ভিন্ন জিনিস। আল্লাহর কাছে নিবেদিত হওয়ার গুঢ় রহস্য কী?

আদম কেন তার পদস্খলনের দায় নিজ কাঁধে নিয়ে বলেন; ‘প্রভুু! আমি নিজের প্রতি জুলুম করেছি’, আর ইবলিস নিজের অপরাধের দায় আল্লাহর ওপর চাপিয়ে যুক্তি দাঁড় করিয়ে বলেছিল; ‘তুমি আমাকে গোমরাহ করেছ, তাই…। তাছাড়া নিয়তির বাধ্যতা ও ইচ্ছার স্বাধীনতা বিতর্কের সমাধান কী? ‘তোমরা যেখানেই থাক, তিনি (আল্লাহ) তোমাদের সঙ্গেই আছেন’ আয়াতের তফসিরসহ রুহ দেহের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে তকদিরের ফয়সালায় সন্তুষ্টি ও শোকরের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয় এ সাক্ষাৎকারে। মওলানার রুমি এ উক্তির রহস্যও বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে বসতে চায়, সে যেন তাসাউফপন্থীর সঙ্গে বসে। সাক্ষাৎকারের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ছিল, পয়গম্বর (আ.)দের অবস্থা অনুধাবন করতে চাইলে কোরআন মজিদকে বুঝতে হবে।

এ আলোচনার গভীরে পৌঁছতে হলে মূল মসনবির শরণ নিতে হবে। এখানে কয়েকটি পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি টানছি। আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে মওলানা বলেনÑ
‘প্রাণের কান ও প্রাণের চোখ জা’হেরি ইন্দ্রিয় হতে ভিন্ন
বুদ্ধির কান ও ধারনার কান তার মোকাবিলায় নিঃস্ব।’

প্রাণের কান ও চোখ অর্থাৎ মানুষের ভেতরের ইন্দ্রিয় বাইরের পঞ্চেন্দ্রিয় থেকে ভিন্ন। এমনকি আকল-বুদ্ধি ও ধারণা অনুমান বলতে যা বোঝায়, তাও হৃদয়ের ইন্দ্রিয়ের বেলায় একেবারে নিঃস্ব। ঐশী এলহাম ও অতিন্দ্রিয় চেতনাকে ধারণ করার শক্তি এদের নেই। সাক্ষাৎকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষের কর্মের স্বাধীনতা বা নিয়তির বাধ্যতা। এই বিতর্কে যুক্তির বাহাদুরি দেখিয়ে প্রথম ধরা খায় শয়তান আর বিনয়ের কারণে পুরস্কৃত হয় আদি পিতা আদম (আ.)।
‘বলল শয়তান, কেন গোমরাহ করেছ আমায়
নিজ কর্মের ভূমিকা লুকায় ইবলিশ সেথায়।’

সৃষ্টির শুরুতে শয়তান আল্লাহর আদেশ মেনে আদম (আ.) কে সিজদা করেনি। এর কারণ জিজ্ঞেস করাতে শয়তান নিজের ভুল তো স্বীকার করেইনি, তদুপরি আল্লাহকে দায়ী করে বলেছে, তুমিই আমাকে গোমরাহ করেছ। তুমি শক্তি না দিলে এ কাজ করার সাধ্য কি আমার ছিল? মওলানা রুমি বলেন; বান্দার কর্ম কি তার নিজের সৃষ্টি, নাকি আল্লাহর সৃষ্টি এ বিতর্ক দীর্ঘদিনের। শয়তান কর্মের সৃষ্টিতে ব্যক্তির ভূমিকার কথা গোপন করে বলেছে, ‘আমি তো যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ।’ তুমিই আমাকে পথভ্রষ্ট করেছ। আদমকে সিজদা করা থেকে বিরত রেখেছ। নিয়তির বাধ্যতা মতবাদে বিশ্বাসীদের মওলানা শয়তানের অনুসারী হিসেবে তীব্র সমালোচনা করেছেন। পক্ষান্তরে আদম বেহেশতে নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার অপরাধে আল্লাহ কৈফিয়ত চাইলেন
‘আদম বললেন, প্রভুহে বড় জুলুম করেছি নিজের প্রতি
আল্লাহ যে কর্মের নিয়ামক-উদাসীন ছিলেন না তার প্রতি।’

নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার কর্মটি আদম করেছিলেন বটে। তার পেছনে আল্লাহর সৃষ্টিকর্মও যুক্ত ছিল। অর্থাৎ আদম (আ.) কাজটি করার শক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকেই পেয়েছিলেন। অন্যথায় করতে পারতেন না। এ তত্ত্বকথা আদমের ভালোভাবেই জানা ছিল। তারপরও আল্লাহপাক যখন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আত্মরক্ষার জন্য কেন বললে না যে, তকদিরের লিখন তো এমনই ছিল। তাই আমি নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছি।

‘বলল, আমি ভয় পেয়েছি কোথাও বেয়াদবি না হয়ে যেন।
বললেন; তোমার আদবের খাতির করেছি, আমিও তেমন।’
মুখে মুখে তর্ক ও বেয়াদবির কারণে শয়তানকে চির অভিশপ্তরূপে বিতাড়িত করেছি, আর তোমার আদবের কারণে তোমাকে আমার সান্নিধ্য দানে ধন্য করেছি। তওবা কবুল করেছি।

কাজেই ‘আল্লাহর শোকর হওয়া চাই প্রত্যেকের গলার মালা
তর্ক ঝগড়া উচিত নয়, কিংবা মুখ বেজার করা।’
অর্থাৎ বান্দার উচিত, যে কোনো অবস্থায় আল্লাহর প্রতি শোকরগুজার থাকা। কোনো অবস্থাতেই মন খারাপ করা, গুমড়ামুখী হয়ে থাকা বা হাহুতাশ করা উচিত নয়।
(সূত্র : মসনবি শরিফ, ১ম খ-, বয়েত নং-১৪৪৬-১৫৪৬)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button