জাকাত কী ও কীভাবে দেবেন?
ঝিনাইদহের চোখঃ
জাকাত ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। অস্বীকার করার সুযোগ তো নেই-ই বরং শর্তহীনভাবে এটি ইসলামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইসলামের অপরিহার্য বিষয়গুলোর একটি। যারা সামর্থ্যবান, তাদের উপর জাকাত আদায় করা নামাজ-রোজার মতই ফরজ।
জাকাতের পরিচয়
জাকাত আরবী শব্দ। পবিত্র কুরআন মাজিদে অসংখ্যবার ইরশাদ হয়েছে, “তোমরা সালাত কায়েম কর এবং জাকাত প্রদান কর”। জাকাত শব্দের অভিধানগত অর্থ পবিত্র হওয়া, পরিশুদ্ধ হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। এটা এ কারণে যে, জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ পরিশুদ্ধ হয়। আল্লাহ তা‘য়ালার অপার মেহেরবাণীতে প্রদানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি পায়। শরীয়তের পরিভাষায়, পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে শরীয়ত কর্তৃক সম্পদের নির্ধারিত অংশকে হাশেমী বংশ এবং তাদের মাওলা ব্যতীত জাকাতের নির্ধারিত খাতসমূহে বণ্টন করে দেয়াকে জাকাত বলে (কানযুদ দাকায়েক)।
যাদের উপর জাকাত ফরজ
জাকাত সবার জন্য ফরজ নয়। কেবল ঐ নেসাব (সাড়ে বায়ান্নতোলা রূপা বা সাড়ে সাততোলা স্বর্ণ অথবা তৎসমপরিমাণ অর্থ) পরিমাণ সম্পদের স্বাধীন ও প্রাপ্তবয়স্ক মালিকের উপর জাকাত ফরজ, যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত করেছে। এক্ষেত্রে বাসস্থান ও নিত্যপ্রয়োজনীয় যে সকল সামগ্রী রয়েছে, তা নেসাবের অন্তর্ভূক্ত হবে না।
জাকাত ফরজ হওয়ার কারণ
সম্পদশালী মাত্রই জাকাত প্রদান করতে হবে, কেননা তা আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক আরোপিত একটি ফরজ কাজ।
(১) জাকাত প্রদান করা আল্লাহর আদেশ: মুসলমান মাত্রই আল্লাহর আদেশ পালণে বদ্ধপরিকর। অমান্য করার সুযোগ নেই। আর যারা অমান্য করে, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেছেন, “তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা কর আর জাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর” (সুরা বাকারা-৪৩)। এখানে সালাতের পরেই জাকাতের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। কেননা ইবাদত দুই প্রকার। একটা দৈহিক, অপরটা আর্থিক। সালাত যেমনিভাবে দেহ-মন সুস্থ রাখে, পরিশুদ্ধ করে। তেমনি জাকাতও অর্থের পরিশুদ্ধতা আনে। অতএব আল্লাহ তা‘আলার আদেশের বাস্তবায়নে জাকাত দিতেই হবে।
(২) সম্পদ পরিশুদ্ধ হয়: জাকাত প্রদানের মাধ্যমে মানুষের সম্পদ পরিশুদ্ধ হয়। ইরশাদ হচ্ছে, “হে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপনি ধনীদের কাছ থেকে (নির্ধারিত খাতের জন্য) সদকা (জাকাত) গ্রহণ করুন। এর মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে থাকবেন” (সুরা তওবা-১০৩)।
(৩) জাকাত অনাদায়ের পরিণাম ভয়াবহ: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যারা সোনা-রূপা জমা করে, অথচ আল্লাহর রাস্তায় তা ব্যয় করে না (জাকাত আদায় করে না), তাদেরকে কষ্টদায়ক আযাবের সংবাদ দিন। যেদিন দোযখের আগুনে তাদেরকে গরম করা হবে। অতঃপর সেগুলো (জমাকৃত সোনা-রূপা) দ্বারা দাগ দেওয়া হবে তাদের ললাটে, পার্শ্বদেশে এবং পৃষ্টদেশে। সেদিন বলা হবে ঐসব জিনিসের স্বাদ গ্রহণ কর, যা তোমরা দুনিয়াতে জমা করেছিলে” ( সুরা তাওবা- ৩৪-৩৫)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বাণী, “যাকে আল্লাহপাক সম্পদ দান করেছেন, আর সে সঠিকভাবে ঐ সম্পদের জাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে তার জন্য একটি বিষাক্ত সাপের রূপ ধারণ করানো হবে। সে সাপকে তার গলার বেড়ীস্বরূপ পড়ানো হবে। সাপটি নিজমুখের দুই দিক দ্বারা ঐ ব্যক্তিকে দংশন করতে থাকবে এবং বলবে আমি তোমার মাল, আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ” (মেশকাত-১৫৫)। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, জাকাত না দেয়ার পরিণাম কত ভয়াবহ, কত জঘন্য, কত পীড়াদায়ক! এরপরেও কি মানুষ জাকাত প্রদানে দ্বিধা করতে পারে?
(৪) জাকাত মানবতার পরিচায়ক: ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ বাদ দিলেও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, মমত্ব ও সাম্যবোধের এক যুগান্তকারী নিয়ম এই জাকাত। সমাজের সম্পদশালী লোকেদের উচিৎ মানবতার তাগিতে অসহায়, দারিদ্র্য, ক্ষুধার্ত ও বস্ত্রহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আর ইসলাম এটিই বলে। তোমার বিশাল সম্পদ থেকে সামান্য অংশ গরীবদের দিয়ে দাও। তা ছাড়া দারিদ্র্যের পাশে দাঁড়ালে মনের ভেতর থেকে যে বিশাল আত্মতৃপ্তি আসে, তা পৃথিবীর অন্য কিছুতে পাওয়া যায় না। কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন-
‘তোর সোনা-দানা ভালা খানা সব রাহে লিল্লাহ
দে জাকাত মুর্দা মুসলিমে আজ ভাঙ্গাইতে নিদ’।
জাকাত অস্বীকার করার পরিণাম
জাকাত যেহেতু কুরআন-হাদীস-এজমা-কিয়াস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত, সেহেতু জাকাত অস্বীকার করা কুফরী। এজন্যই ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁর খেলাফতকালে যারা জাকাতকে অস্বীকার করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম, যারা সালাত এবং জাকাতের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করে’।
যাদেরকে জাকাত প্রদান করতে হবে
মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের সুরা তাওবার ৬০নং আয়াতে স্পষ্টাকারে মোট ৮ প্রকার মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন, আর তারা হলো-
(১) ফকির। যাদের কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। মিসকিন থেকে ভালো অবস্থান।
(২) মিসকিন বা নিঃস্ব ব্যক্তি। যার কাছে তেমন কোন ধন-সম্পদ নেই।
(৩) আমিলুন তথা জাকাত উত্তোলন, সংরক্ষণ ও বন্টনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি।
(৪) মুআল্লাফাতুল কুলুব। কাফির ও নওমুসলিমকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে। (এটি ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার পর বিলুপ্ত ঘোষিত হয়।)
(৫) দাসমুক্তির জন্য। কৃতদাস কিংবা বন্দী মুক্তির জন্য।
(৬) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের নিমিত্তে জাকাত দেয়া যাবে।
(৭) ফি সাবিলিল্লাহ তথা গাজী-মুজাহিদের যুদ্ধের সরঞ্জাম কিনতে, গরীব ইলম তলবকারী শিক্ষার্থীর খরচ ইত্যাদি ফি সাবিলিল্লাহর অন্তর্ভূক্ত।
(৮) মুসাফির। মুসাফির যদিও নিজদেশে ধনী হয়, তাকে জাকাত প্রদান করা যাবে।
একটি সুন্দর পরিকল্পনা
আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, জাকাত দেবার কোন সুনির্দিষ্টতা নেই। নেই কোন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, নেই নিয়ম-শৃংখলায় আবদ্ধ। যার যেভাবে ইচ্ছা, সেভাবে জাকাত আদায় করে থাকেন। ৫০-১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০-২০ টাকা পর্যন্ত জাকাত দিতে দেখা যায়। একটি লুঙ্গি কিংবা শাড়ির জন্য মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। যার ফলে জাকাতের যে মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, তা ব্যহত হচ্ছে। দারিদ্র্যের মুক্তি মিলছে না। কমছে না অভাবির সংখ্যা। অথচ জাকাতের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে দরিদ্রতা কমানো। তো কীভাবে দিলে জাকাতের সে মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হবে? ধরুন, কারো পাঁচ লাখ টাকা জাকাত আসলো। ঐ টাকা যদি যাকে-তাকে না দিয়ে পাঁচজন চিহ্নিত গরীব লোককে দেয়া হয়, তবে পরবর্তী বছর সে লোকগুলোর আর জাকাতের প্রয়োজন হবে না। এভাবে যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিবছর জাকাত প্রদান করা হয়, তবে দেশের দ্ররিদ্রতা অনেকাংশে কমে আসবে। সাথে সাথে জাকাতের যে মহৎ উদ্দেশ্য, সেটাও সাধিত হবে।
মনে রাখতে হবে জাকাত দান নয়, গরীবের অধিকার। অবশ্য আল্লাহ তা‘য়ালা এর উত্তম বিনিময় প্রদান করবেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে ইসলামের সঠিক বিধান মেনে জাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন! বেহুরমাতে সায়্যিদিল মুরসালিন।