আল্লাহ কি নিরাকার? (১ম পর্ব)

ঝিনাইদহের চোখঃ
‘রব’ শব্দের অর্থ হল সর্বময় কর্তা, প্রতিপালক, লালন-পালনকারী, ইত্যাদি। আর এসব অর্থ হিসেবে আল্লাহ তাআলার জন্য এ পবিত্র নামটি শোভনীয় হয়েছে। রব শব্দটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে ব্যবহৃত হতে পারে না।
রবের পরিচয়-
আল্লাহ তাআলা যখন মুসা ও তাঁর ভাই হারুন আঃ কে বললেন, তোমরা ফিরআউনের নিকট গিয়ে বল, আমরা তো জগত সমূহের রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল। তখন ফিরআউন বলল, জগত সমূহের রব আবার কে? মুসা আঃ বললেন, তিনি আকাশমন্ডলী পৃথিবী এবং মধ্যবর্তী সব কিছুর রব বা প্রতিপালক, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। (সূরা শুআরা- ২৬/২৩-২৪)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্রে বলেন, যে, তার রবের সাথে সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে, (সূরা ফাহাফ-১৮/১১০)
১. আল্লাহর হাত-
আল্লাহ তাআলা বলেন, অতএব মহান সেই সত্তার পবিত্রতা বর্ণনা করছি যাঁর হাতে রয়েছে প্রত্যেক বিষয়ের সার্বভৌম ক্ষমতা এবং যাঁর কাছেই তোমাদের সকলকে ফিরে যেতে হবে। (সূরা ইয়াছিন-৩৬/৮৩)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্রে বলেন, হে ইবলিস! আমি যাকে আমার নিজ দু’হাতে সৃষ্টি করলাম তাকে সিজদা করতে কিসে তোমাকে নিষেধ করল? তুমি কী দম্ভ দেখালে, নাকি তুমি খুব উচ্চ মানের অধিকারী হয়েছ? (সূরা সোয়াদ- ৩৮/৭৫)
রাসূল (সা.) বলেন, রাত্রে আল্লাহ তাআলা তাঁর হাতকে প্রশস্ত করেন তাঁর বান্দার দিনের গুনাহ মাফের জন্যে এবং দিনে আল্লাহ তাঁর হাতকে প্রশস্ত করেন, বান্দার দিনের গুনাহ মাফের জন্য, সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হওয়া পর্যন্ত। (সহীহ মুসলিম, হা- ২৭৫৯ শামেলা)
রাসূল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ সদকাকে গ্রহণ করেন এবং তা ডান হাতে গ্রহন করেন, অতপর তিনি তোমাদের জন্য তা নিজ হাতে লালন পালন করেন, যেভাবে তোমাদের কেউ তার দুধ ছাড়ানো গাভী বা ঘোড়ার বাচ্চা লালন-পালন করে থাকে। (তিরমিযী, হা- ৬৬২, শামেলা)
২. আল্লাহর দুই হাত-
আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ইবলিস! তোমাকে কোন জিনিস তাকে সিজদা করা থেকে বিরত রাখলো যাকে আমি নিজের দু-হাত দিয়ে বানিয়েছি, তুমি কি এমনই ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি কোনো উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কেউ? (সূরা সোয়াদ- ৩৮/৭৫)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্রে বলেন, বরং আল্লাহর উভয় হাত উন্মুক্ত, যেভাবে চান সেভাবেই তিনি দান করেন। (সূরা-আল-মায়িদাহ-৫/৬৪)
রাসূল (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন সাত আকাশকে ভাজ করা অবস্থায় ডান হাতে ধরবেন, অতপর বললেন, আমিই বাদশাহ, কোথায় সেই দাম্ভিক অহংকারীরা? আবার সাত জমিনকে ভাঁজ করা অবস্থায় বাম হাতে ধরবেন, অতপর বলবেন আমিই রাজধিরাজ কোথায় সেই দাম্ভিক অহংকারীরা? (মুসলিম, হা- ২৭৮৮ শামেলা)
৩. আল্লাহ হাতের আঙ্গুল-
আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাঃ বলেন, তিনি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছেন যে, সমস্ত আদম সন্তানের অন্তর সমূহ রহমানের দু’আঙ্গুলের চিপার মধ্যে রয়েছে। (মুসলিম, হা- ২৬৫৪)
৪. হাতের পাঁচ আঙ্গুল-
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন, পাদ্রীদের একজন পাদ্রী রাসূল (সা.) এর নিকট এসে বলল, হে মুহাম্মদ (সা.) আমরা তাওরাতে পাই যে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন আকাশ সমূহ এক আঙ্গুলের উপর, জমিন সমূহ এক আঙ্গুলের উপর, গাছসমূহ এক আঙ্গুলের উপর, পানি ও কাদা এক আঙ্গুলের উপর রেখে বলবেন, আমিই বাদশাহ।
এ কথা শুনে রাসূল (সা.) পাদ্রীর কথা কে সত্যায়িত করার জন্য এমনভাবে হেসে দিলেন যে, রাসূল (সাঃ এর মাড়ির দাঁত বের হয়ে গেল এবং তিনি পাঠ করলেন, আর তারা আল্লাাহকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়নি, অথচ কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর মুষ্টিতে এবং আকাশ সমূহ তাঁর ডান হাতে ভাঁজ করা থাকবে। (বুখারী হাঃ-৪৫৩৩, সূরা যুমার-৬৭)
৫. হাতের তালু-
আবু দারদা রাঃ হতে বর্ণিত, নাবী (সা.) বলেন, সৃষ্টির প্রাক্যালে আল্লাহ তাআলা যখন আদম আঃকে সৃষ্টি করলেন তখন তাঁর ডান কাঁধের উপর তাঁর হাত মারলেন, এতে ক্ষুদ্র পিপড়ার দলের ন্যায় সুন্দর ঝকঝকে একদল আদম সন্তান বেরিয়ে আসলো, তিনি আবার তাঁর বাম কাঁধের উপর হাত মারলেন এবং কয়লার ন্যায় কালো অপর একদল আদম সন্তান বেরিয়ে আসলো, তারপর আল্লাহ তাআলা আদম আঃ এর ডানদিকের সন্তানদের সন্তানদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এ’দল জান্নাতী। এতে আমি কারো পরোয়া করি না।
অতপর আবার তিনি বামদিকের সন্তানদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন এ দল জাহান্নামী। এসম্পর্কে ও আমি কারো পরোয়া করি না, (আহমদ, হাঃ-২৬৯৪২/২৭৫২৮, মিশকাত হা- ১০২/১১৯) ইবনে আব্বাস রাঃ হতে বর্ণিত তিনি বলেন, সাত আকাশও সাত জমিন রহমানের হাতের তালুর মধ্যে এতটাই ক্ষুদ্র যেমন তোমাদের হাতের তালুর মধ্যে একটি সরিষার দানা। (তাফসীর ইবনে জারীর ত্বাবারী-২৪/৩২)
৬. হাতের আঞ্জলি-
আবু উমামা রাঃ বলেন, আমি নবী (সা.) কে বলতে শুনেছি, আমার প্রতিপালক আমার সাথে এ ওয়াদা করেছেন যে, তিনি আমার উম্মতের মধ্য হতে সত্তর হাজার ব্যক্তিকে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তাদের কোনো হিসাব হবে না, তাদের কোনা শাস্তিও হবে না। আবার উক্ত প্রত্যেক হাজারের সাথে সত্তর হাজার ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তারপর আমার প্রতিপালকের তিন অঞ্জলি সমপরিমান মানুষকেও জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। (আহমদ, হাঃ-২২৩৫৭, মিশকাত শামেলা, হাঃ-৫৫৫৬)
৭. পা আছে-
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, স্মরণ করুন সেই দিনের কথা (কিয়ামতের দিন) যেদিন পায়ের গোছা (হাঁটুর নিন্মাংশ) উন্মোচিত করা হবে এবং সেদিন তাদেরকে ডাকা হবে সিজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না। (সুরা ক্বালাম-৪২)
আবু সাইদ খুদরী রাঃ বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, আমাদের রব তাঁর পায়ের গোছা অনাবৃত করবেন, ফলে প্রতিটি মুমিন মুমিনা নরনারী তাঁর জন্য সিজদা করবেন, পক্ষান্তরে যারা দুনিয়াতে লোক দেখানো ও প্রসিদ্ধি অর্জনের জন্য সিজদা করে ছিল তারা সিজদা করতে সক্ষম হবে না। তারা সিজদা করতে যাবে কিন্তু সিজদা করার জন্য তাদের পিঠ বাঁকা হবে না। (বুখারী, হা- ৪৯১৯/৪৬৩৫)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্রে বলেন, সেদিন আমি জাহান্নামকে বলব, তুমি কি পরিপূর্ণ হয়েছ? আর সে বলবে, আরো বেশী আছে কি? (সূরা ক্বাফ-৩০)
আনাস বিন মালেক রাঃ বলেন, জাহান্নামীদের জাহান্নামে ফেলা হবে শেষ পর্যন্ত জাহান্নাম বলবে, আরো বেশি আছে কি? অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র পা জাহান্নামের রাখবেন। তখন জাহান্নাম বলবে, যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। (বুখারী হা- ৪৮-৪৯/৬২৮৪, মুসলিম, হা- ২৮৪৬)
ইমাম আ’যম আবু হানীফা রঃ মহান আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে বলেন, তাঁর মুখমন্ডল ও আত্মা আছে যেমন আল্লাহ তাআলা কুরআনে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ তাআলার চেহারা, হাত, পা ও দেহের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা আল্লাহর দৈহিক বৈশিষ্ট। আমরা তাঁর ঐ সকল অঙ্গের বিশদ বিবরণ জানি না। তাই বলে কেউ যেন আল্লাহর হাতকে কুদরতী হাত বা নেয়ামতের হাত না বলে, আর যারা কুদরীত হাত বলে তারা কাদরিয়াহ ও মুতাযিলার লোক। (ফিকহুল আকবার-৫৮-৫৯ পৃঃ)
লেখক : মাওলানা আখতারুজ্জামান খালেদ, সাবেক ইমাম ও খতীব, দুপ্তারা, কুমারপাড়া, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ।