বিজ্ঞানের পথচলায় মুসলিম মনীষীদের অবিস্মরণীয় অবদান

ঝিনাইদহের চোখঃ
আধুনিকতার দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দিক হচ্ছে বর্তমান যুগ। এ যুগে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে ব্যাপক আকারে। দিন দিন বিজ্ঞানের প্রসারতা বাড়ছে, মানুষ আরও বেশি প্রযুক্তি মুখর হচ্ছে। দৈনন্দিন কাজের প্রতিটা ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগে আছে। কিন্তু এই আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তিস্তর যাদের হাত ধরে তাদের কথা হয়ত অনেকেরই মনে নেই।
বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার সঠিক ইতিহাস নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে। কেউ দাবি করেন বিজ্ঞান শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে খ্রিস্টান আর ইহুদীদের হাত ধরে। আবার কারো দাবি বিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি অবদান মুসলমানদের। কিন্তু মুসলমানদের অবদান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
সময়ের ধারাবাহিকতায় মুসলিম মনিষীদের হাত ধরেই স্থাপিত হয়েছে বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর। রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাসহ বিজ্ঞানের প্রতিটি বিভাগে এক সময় ছিল মুসলিম মনিষীদের সরব উপস্থিতি। খলিফা মনসুর, হারুন অর রসিদ, মালিক শাহ ও মামুনের সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা অনেকদূর পর্যন্ত পৌঁছে ছিল। বাগদাদ, মিশর, মরক্কো, স্পেন, পারস্য, সিসিলি, গ্রানাডা প্রভৃতি স্থান ছিল সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, অঙ্ক, বিজ্ঞান, বীজগণিত, জ্যামিতি, চিকিৎসা শাস্ত্র, সামরিক শিক্ষা, তফসীর, হাদিস, ফেকাহ, শিল্পকলা, নৌবিদ্যা, শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ের জন্য শিক্ষা লাভের প্রাণকেন্দ্র। এক কথায় বলতে গেলে ইউরোপে যখন জ্ঞানের আলো পৌঁছেনি তখনও আরববাসী জ্ঞান-বিজ্ঞানে ছিলেন অনেক অগ্রগামী।
কিন্তু একদল ইসলামবিদ্বেষী কর্তৃক স্পেনে মুসলিমদের পরাজয়ের পরই সদ্য প্রজ্জ্বলিত প্রদীপটি হঠাৎই নিভে যায়। তারা আগুন লাগিয়ে দেয় হাজার হাজার লাইব্রেরীতে। হত্যা করে মুসলিম দার্শনিকদের। জ্ঞানের সমুদ্র থেকে জ্ঞানপিপাসুদের ঠেলে দেয় জ্ঞানহীন মরুপ্রন্তরে। মুসলিমদের বিজ্ঞানসাধনা স্তিমিত হয়ে আসতে থাকে। বিজ্ঞানশাস্ত্রে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে ইসলামবিদ্বেষী শক্তি।
বিজ্ঞানের ভিত্তিস্তর প্রতিষ্ঠায় যে সকল মুসলমানদের অবদান ছিল বলে জানা যায়-
জাবির ইবনে হাইয়ান:
আধুনিক কেমিষ্ট্রির জনক হিসেবে জানা হয় জাবির ইবনে হাইয়ানকে। কেবল রসায়নই নয় বরং পদার্থবিজ্ঞান, গণিতসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাস্ত্রেও ছিল তার অসাধারণ দখল। এই মহান বিজ্ঞানীর রচিত প্রায় দুই হাজারেরও বেশি গ্রন্থ রয়েছে।
যে ‘আলকেমি’র ইউরোপীয় ভার্সন আজকের কেমিষ্ট্রি সেই ‘আলকেমি’ শব্দটির জনক ছিলেন জাবির ইবনে হাইয়ান। মারকাসাইট থেকে লেখার স্থায়ী কালি, ম্যাঙ্গানিজ-ডাই-অক্সাইড থেকে কাঁচ তৈরির পদ্ধতি জানতেন তিনি। তাছাড়া নাইট্রিক এসিড, আর্সেনিক, এ্যান্টিমনি, সিলভার নাইট্রেট, কিউপ্রিক ক্লোরাইড প্রভৃতি সম্পর্কেও যথেষ্ট জ্ঞান ছিল তাঁর। তাছাড়া তাঁর বিভিন্ন বইতে পাতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপাদানের পৃথকীকরণ এবং উর্ধ্বপাতন সংক্রান্ত আলোচনাও রয়েছে।
ইবনেসিনা:
চিকিৎসাবিজ্ঞান শব্দটির সাথে ইবনেসিনা নামটি জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। আধুনিক সমাজের কোনো ধরনের সুবিধা না পেয়েও তাঁর লেখা গ্রন্থগুলো আজও অমর হয়ে রয়েছে।
ইবনেসিনা সর্বপ্রথম ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেন। মানসিক স্বাস্থ্য এবং শারীরিক ব্যবস্থার মধ্যে যোগসূত্র সম্পর্কে তিনিই প্রথম জানান এবং কথা বলেন। তাঁর রচিত বইয়ের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও প্রায় শতাধিক বলে ধারনা করা হয়। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর তাঁর রচিত ২৪টি বড় এবং ২১টি ছোট বই আজও অমর। ইবনেসিনা রচিত ‘কানুন ফিত তিবব’ বইটিকে ড. ওসলার চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলে উল্লেখ করেছেন।
আবু বকর আল রাযি:
আবু বকর আল রাযি শল্য চিকিৎসায় ছিলেন ঐ সময়কার সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিদ। তিনি গ্রিকদের চেয়েও উন্নত পদ্ধতিতে অস্ত্রোপচার করতেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ প্রায় দুই শতাধিক। যার মধ্যে একশরও বেশি গ্রন্থ চিকিৎসা বিষয়ক। বসন্ত ও হামের উপরে তাঁর রচিত ‘আল জুদায়ী ওয়াল হাসবাহ’ গ্রন্থটি এতই মৌলিক ছিল যে খ্রিষ্ট জগতের লোকেরা এর পূর্বে এ ধরনের বিষয়গুলো চিন্তাও করতে পারে নি।
হাসান ইবনে হাইসম:
চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরেক কিংবদন্তীর নাম হাসান ইবনে হাইসম। তিনি একাধারে চিকিৎসক, পদার্থবিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ। ‘আধুনিক অপটিকস’ সম্পর্কে হাসান ইবনে হাইসমই সর্বপ্রথম ধারনা প্রদান করেন। চক্ষু চিকিৎসায় তাঁর সফলতা এত বেশি ছিল যে সমকালিন চিকিৎসকরা থমকে দাঁড়িয়েছিল। দৃষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ক তাঁর রচিত ‘কিতাবুল মানযির’ নামক গ্রন্থটি আজও অমর। তিনি আলোক সম্পর্কিত গ্রিকদের ভুল ধারনার অবসান করেন।
আল খুজান্তী:
সেক্সট্যাণ্ট এমন এক যন্ত্র যার দ্বারা গ্রহ নক্ষত্রের উন্নতি এবং অবনতি কোণ পরিমাপ করা হয়। আর এই সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের আবিষ্কারক আল খুজান্তী নামের একজন বিখ্যাত মুসলিম পদার্থবিজ্ঞানী।
আল হাসান:
প্রাচীনকালে টলেমির মত বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও বিশ্বাস করতেন যে কোনো বস্তুকে দেখার জন্য চোখই আলোকরশ্মি পাঠায়। কিন্তু হাজার বছর ধরে চলতে থাকা এ ধারনাকে গবেষণার মাধ্যমে ভুল প্রমানিত করেন মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাসান।
তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে কোনো উপায়ে আলোকরশ্মি চোখে এসে পড়লেই চোখ কেবল বস্তুটি দেখতে পায়। আধুনিকতাবিবর্জিত সে সমাজেও তিনি ম্যাগনিফায়িং গ্লাস তথা উত্তল লেন্সকে আধুনিক উত্তল লেন্সের আকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যান এবং টলেমির স্থুল (Crude) সূত্র সম্পর্কে তিনিই প্রথম জানান যে আপাতন কোণ ও প্রতিসরণ কোণ যে সমানুপাতিক তা শুধু ক্ষুদ্র আপাতন কোণের বেলায় সত্য।
ইবনে ইউসুফ:
মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে ইবনে ইউসুফ আরেকজন সফল জোতির্বিজ্ঞানী। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী ২০০ বছরের জোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করে জোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক একটি সারণি তৈরি করেন। এ সারণির নাম ছিল ‘হাকেমাইট অ্যাাস্ট্রোনমিক্যাল টেবিল’।
আল হাকিম:
আল হাকিম কায়রোর খলিফা থাকাকালীন ৯৯৫ সালে একটি বিজ্ঞানাগার নির্মাণ করেন।
আল মাসুদী:
বিজ্ঞানী আল মাসুদী ‘History of nature’ বা ‘প্রকৃতির ইতিহাস’ বিষয়ে একটি এনসাইক্লোপিডিয়া রচনা করেন। এ বইটিতে ডরহফসরষষ বা বায়ূকলের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আল খারিযমী:
বীজগণিতের ইংরেজী প্রতিশব্দ ‘Algebra’ শব্দটির জনক আল খারিযমী। এই ‘Algebra’ বা ‘এলজাবরা’ শব্দটি এসেছে ‘হিসাব আল জাবর ওয়াল ওয়াল মুকাবাহ’ নামক গ্রন্থটির ইউরোপীয় সংক্ষিপ্ত ভার্সন হিসাবে। তাকে আধুনিক বীজগণিতের জনক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আল খারিযমীর রচিত গ্রন্থে প্রায় আট শতাধিক বিভিন্ন উদাহরণ সন্নিবেশিত রয়েছে। সমীকরণ সমাধানের প্রায় ছয়টি নিয়ম তিনি আবিষ্কার করেছিলেন।
উমার খাইয়াম:
সফল মুসলিম গণিতবিদদের মাঝে এক অনন্য নাম উমার খাইয়াম। তাঁর রচিত ‘কিতাবুল জিবার’ গ্রন্থটি একটি বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ। দ্বিঘাত সমীকরণের সমাধানের পদ্ধতি নিয়ে বেশি আলোচনা করেছেন তিনি। তাছাড়া সম্পাদ্যসমূহ নিখুঁতভাবে অঙ্কনের পদ্ধতিও বর্নিত হয়েছে তাঁর গ্রন্থে।
আল বিরুনী:
গণিতশাস্ত্রের বিশ্বকোষ হিসাবে বিবেচনা করা হয় ‘আল কানুন আল মাসউনী’ নামক বইটিকে। মুসলিম বিজ্ঞানী আল বিরুনী কতৃক রচিত এই বইটিতে রয়েছে জ্যামিতি ও ত্রিকোনমিতির বিস্তারিত সকল আলোচনা। তিনি পৃথিবীর পরিমাপ সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছিলেন তা আজও প্রতিষ্ঠিত।
গণিতবিদ আল খারিযমী গণিতের পাশাপাশি ভুগোল শাস্ত্রেও ব্যাপক সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ভুগোল সংক্রান্ত টলেমির রচিত গ্রন্থটি তিনি অনুবাদ করেন এবং সেই সাথে সংযুক্ত করেন একটি মানচিত্রও। তিনি টলেমির অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ সংক্রান্ত তথ্যগুলো গ্রহণ করেন এবং তার সাথে মুসলিম দেশসমূহের সীমারেখাও জুড়ে দেন। আল খারিযমী পৃথিবীকে সাতটি ইকলীম বা মন্ডলে ভাগ করেন। এর সূত্র ধরেই পরবর্তীতে ভাগ করা হয় সাতটি মহাদেশ।