হযরত নূহ আলাইহিস সালামের জীবনী (পর্ব ১)

ঝিনাইদহের চোখঃ
মুহাররাম মাস আরবী হিজরি সনের প্রথম মাস। মুহাররাম মাসে পৃথিবীতে প্রধান প্রধান উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে এ মাসের ১০ তারিখ দিনটি বারো মাসের শ্রেষ্টতম স্বরণীয় দিন গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দিন। আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ছয়টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, লূত্ব, কওমে মাদইয়ান ও কাওমে ফেরাউন সম্পর্কে আল্লাহ তাআল কুরআনে আলোচনা করেছেন। ফলে তাদের সংশোধনের জন্য এবং পথভোলা মানুষদের সুপথে আনার জন্য তাদের মধ্যে হতে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছিলেন। তন্মধ্যে প্রথম ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি হল নূহ আঃ এর জাতি বা কওমে নূহ। তাদের এ আজাবের সম্পাপ্তি মুহাররাম মাসের ১০ তারিখে হয়েছিল।
১। পরিচয়-
আদম আঃ থেকে নূহ আঃ পর্যন্ত দশ শতাব্দির ব্যবধান ছিল। যার শেষ দিকে মানবকূল শিরক ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল এবং তা বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহ তাআলা নূহ আঃ কে তাদের মাঝে রাসূল রূপে প্রেরণ করেন। তিনি ৯৫০ বছরে দীর্ঘ বয়স লাভ করেছিলেন এবং সারা জীবন পথভোলা মানুষকে সুপথে আনার জন্য দাওয়াতি কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
কিন্তু তার স্ব-জাতি তাকে প্রত্যাখ্যান করে। ফলে আল্লাহর গজবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এ জাতির ঘটনা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে এবং কুরআনের মাধ্যমে জগতবাসী জানতে পেরেছে। হযরত নূহ আঃ, হযরত আদম আঃ এর দশম বা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ ছিলেন। সে জন্য তাকে ‘‘আবুল বাশার সানী” বা দ্বিতীয় আদম বলা হয়। তিনি দুনিয়াতে প্রথম রাসূল ছিলেন। (সহীহ মুসলিম, হা- ৩২৭)
২। নূহ আঃ এর জন্ম-
বর্তমান ইরাকের মুছেল নগরীর উত্তর প্রান্তে নূহ আঃ এর জন্ম হয়েছিল। তার চারটি পুত্র ছিল। হাম, সাম, ইয়াফিস ও ইয়াম বা কেনআন। প্রথম তিন জন নূহ আঃ এর প্রতি ঈমান আনেন, শেষজন কাফের হয়ে মহা প্লাবনে ডুবে মারা যায়। (তাফসীরে কুরতুবী)
মহাপ্লাবনের শেষে তার তিন পুত্র হাম, সাম, ও ইয়াফিস এর বংশধর বেঁচে ছিলেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, সূরা ছাফফাত- ৭৭)
আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি তার (নূহ আঃ) বংশধরগণকেই অবশিষ্ট রেখেছি। (সূরা ছাফ্ফাত- ৭৭)
রাসূল সাঃ বলেন, সাম আরব জাতির আদি পিতা, হাম আফ্রিকীয়দের আদি পিতা ও ইয়াফিস রোমকদের (গ্রীক) আদি পিতা। (আহমদ,হা- ১৯৯৮২)
ফলে ইহুদী খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্মের লোকেরা নূহ আঃ কে তাদের আদি পিতা হিসেবে মর্যাদা দিয়ে থাকে।
ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, নূহ আঃ ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন এবং মহাপ্লাবনের পর ৬০ বছর বেঁচে ছিলেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, সূরা আনকাবুত- ১৪/১৫)
৩। তৎকালীন সামজিক অবস্থা-
আদম আঃ এর সময় শিরক ও কুফরের মোকাবেলা ছিল না। তখন সবাই তাওহীদের অনুসারী ও একই উম্মত ছিলেন। (সূরা বাকারা- ২১৩)
কিন্তু কালের বিবর্তনে মানুষের মধ্যে শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটে। নূহ আঃ এর স্বজাতি ওয়াদ্দা, সুওয়া, ইয়াগুছ ও ইয়াউক এবং নাসর প্রমুখ নেককার লোকদের উসিলায় আখিরাতে মুক্তি পাবার আশায় তাদের কবর পাকা করে পূজা শুরু করে।
আদাম আঃ ও নূহ আঃ এর মধ্যবর্তী সময়কালে এই পাঁচ জন ব্যক্তি নেককার ও সৎকর্মশীল বান্দা হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর তাদের ভক্ত অনুসারীদেরকে শয়তান এই বলে প্ররোচনা দেয় যে, এই সব নেককার মানুষের মূর্তি সামানে থাকলে তাদের দেখে আল্লাহ তাআলার প্রতি ইবাদতে অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হবে। ফলে তারা তাদের মূর্তি বানিয়ে পূজা শুরু করে। তাদের মৃত্যুর পর তাদের বংশধরেরা মূর্তি পূজা অব্যহত রাখে, আর এভাবেই পৃথিবীতে প্রথম মূর্তি পূজার শিরকের সূচনা হয়। (ইবনে কাসীর, বুখারী, হা- ৪৯২০)
অতএব, পৃথিবীর প্রাচীনতম শিরক হল নেককার মানুষের কবর পাকা করে ইবাদতগাহ বানানো এবং পরবর্তীতে তাদের মূর্তি বানিয়ে পূজা করা। যা, আজও প্রায় সকল ধর্মে রূপ নিয়েছে।
৪। দাওয়াত ও প্রচার-
আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি নূহ আঃ কে তার স্বজাতির নিকট প্রেরণ করলাম তাদের উপর মর্মান্তিক আজাব আসার পূর্বেই তাদেরকে সর্তক করার জন্যে। নূহ আঃ তাদের কে বললেন, হে আমার জাতি! আমি তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট সতর্ককারী। এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। তাতে আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দেবেন। তবে এটি নিশ্চিত যে, আল্লাহর নির্ধারিত সময় যখন এসে যাবে তখন তা এতটুকু পেছানো হবে না, যদি তোমরা জানতে। (সূরা নূহ- ১/৪)
নূহ আঃ স্বজাতিকে দিন-রাত, প্রকাশ্যে ও গোপনে দাওয়াত দেন। কিন্তু তারা তার দাওয়াতে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে দেখলে পালিয়ে যেত, কখনো কানে আঙ্গুল দিত, কখনো তাদের চেহারা কাপড় দিয়ে ডেকে ফেলতো। তারা তাদের হঠকারীতা ও জেদে অটল থাকতো এবং চরম ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতো। (সূরা নূহ- ৬/৯)
চলবে…