কালীগঞ্জটপ লিড

সবই ডায়েরিতে লিখে চলেছেন ঝিনাইদহের পদকপ্রাপ্ত হেলাল উদ্দিন

ঝিনাইদহের চোখঃ

বাবা জোনাব আলী কোন সালের কত তারিখে মারা গেছেন, কোনোভাবেই বের করতে পারছিলেন না ছেলে বাকের আলী। মৃত্যুর ওই দিনটি লিখে রাখেননি পরিবারের সদস্যরা। একইভাবে নজরুল ইসলামও তাঁর মায়ের মৃত্যুর দিনটি হারিয়ে ফেলেছিলেন। উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মৃত রফিউদ্দিন আহম্মদ কেমন মানুষ ছিলেন, সেটাও ভুলে গেছেন অনেকে।

ভুলে যাওয়া স্মৃতি বা হারিয়ে যাওয়া দিন—সবই ডায়েরির পাতায় ধরে রেখেছেন কোনোরকমে লিখতে পারা পদকপ্রাপ্ত আদর্শ কৃষক হেলাল উদ্দিন (৬৯)। দীর্ঘ ২৩ বছরে তিনি ৫০টির বেশি ডায়েরিতে হাজার মানুষের সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং তাদের জন্ম–মৃত্যুর তারিখ লিখে রেখেছেন। মৃত্যুর খবর পেলেই সেখানে ছুটে যান তিনি। সংক্ষিপ্ত জীবনী সংগ্রহ করে লিখে রাখেন, যা পরে অনেকেরই কাজে লাগে। পাশাপাশি নতুন যারা জন্ম নিচ্ছে, তাদের জন্মের তারিখও লিখে রাখেন।

হেলাল উদ্দিন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের মৃত ফকির আলী মণ্ডলের ছেলে। কৃষিকাজ করে সংসার চালান। স্ত্রী মাহিরন নেছা এবং চার মেয়ে, তিন ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। ছেলেমেয়ে সবাই বিবাহিত। হেলাল উদ্দিন বললেন, ‘বাবার ছিল মাত্র ৭০ শতক জমি। আমরা তিন ভাই ও এক বোন। জমিতে ঠিকমতো চাষাবাদ হতো না। বড় ভাই দেলবার আলী ১৯৭১ সালে কলেরা রোগে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। আরেক ভাই খেলাফত আলী মারা যান ক্যানসারে। সংসারে অভাব থাকায় পড়ালেখা করতে পারিনি।’ ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে মাঠের কাজে যেতে হয়েছে হেলাল উদ্দিনকে। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। সেটুকুই কাজে লাগিয়েছেন।

‘নিয়মিত ডায়েরি লিখি। অনেক ভুল হয়, তবুও লিখে যাচ্ছি।’ বলেন হেলাল উদ্দিন।

১৯৯৬ সালে হেলাল উদ্দিন প্রথমবার যখন নিয়ামতপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তখন থেকেই এই ডায়েরি লেখার শুরু। পরিষদে প্রথম সভাতে বসেই একজনের মৃত্যুর খবর পান। তখনই তাঁর মনে হয় এই ব্যক্তিটি পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতো চলে যাচ্ছেন। দু-চার বছর পর তাঁর কথা হয়তো কেউ মনে রাখবে না। তাঁর জন্ম-মৃত্যুর দিনটিও সবাই ভুলে যাবে। সেই সময় তাঁর মনে হয় হারিয়ে যাওয়া ওই মানুষটি সম্পর্কে কিছু লিখে রাখা যায়। এভাবেই তাঁর এই কাজ শুরু হয়। সর্বশেষ গত ২০ ডিসেম্বরে তাঁর গ্রামের চিত্তরঞ্জন মারা গেছেন। তাঁর কথাও হেলাল উদ্দিন লিখে রেখেছেন।

কিছুদিন আগে হেলাল উদ্দিনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, একটি কাঠের আলমারিতে সাজানো রয়েছে ডায়েরিগুলো। টেবিলের ওপরেও কয়েকটি। এগুলো খুললেই দেখা যায় সেখানে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর তারিখ আর সংক্ষিপ্ত জীবনী। অনেকের জন্মতারিখও লেখা আছে ডায়েরিতে। ডায়েরিগুলো তিনি বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করে থাকেন বলে জানান। তাঁর এই কাজ দেখে অনেকে ডায়েরি উপহারও দিয়েছেন।

মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের গোলাম মোস্তফা মনে করছেন হেলাল উদ্দিন সমাজে অনেক অবদান রেখে চলেছেন। তিনি নিজের এলাকায় সফল একজন ব্যক্তি। কৃষিক্ষেত্রে অবদান রেখে অনেক পদকও পেয়েছেন। নিয়ামতপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান রনি লস্কর বলেন, ‘হেলাল উদ্দিন সব ভালো কাজের সঙ্গেই আছেন। তাঁর ডায়েরি লেখার কাজটিও একটি ভালো কাজ।’

একেবারেই নিজের উদ্যোগ আর নিজের যা আছে, তা নিয়েই হেলাল উদ্দিন গড়ে তুলছেন এলাকার মানুষের জীবনের তথ্যভান্ডার, যা ভবিষ্যতে অনেকেরই কাজে লাগতে পারে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button