ধর্ম ও জীবন

গওস, কুতুব, আবদাল ও নুজাবা সম্পর্কে ইসলাম যা বলে

ঝিনাইদহের চোখঃ

আমাদের সমাজে ধার্মিক মানুষের মধ্যে বহুল প্রচলিত পরিভাষা রয়েছে, গওস, কুতুব, আওতাদ, আকতাব, আবদাল ইত্যাদি। সাধারণভাবে আমাদের এই উপমহাদেশে আওলিয়ায়ে কেরামকে বুঝাতে এ সকল শব্দ ব্যবহার করা হয়।

এ সকল পরিভাষার বিশেষ অর্থ ও বিশেষ বিশেষ পদবীর কথা প্রচলিত আছে। আরও প্রচলিত আছে যে, পৃথিবীতে এতজন আওতাদ, এতজন আকতাব, এতজন কুতুব, এতজন গওস ইত্যাদি সর্বদা বিরাজমান আছে। এগুলো সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামে মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। একমাত্র “আবদাল” ছাড়া অন্য কোনো শব্দ বা উপাধী কোনো হাদীসে বর্ণনা করা হয়নি। গওস, কুতুব, আওতাদ ও আকতাব ইত্যাদি সকল পরিভাষা, পদ-পদবী ও সংখ্যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে কোনো কিছুই সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়নি। শুধুমাত্র “আবদাল” শব্দটি অনেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

আবদালের পরিচয়-

“আবদাল” শব্দটি “বদল” শব্দের বহুবচন। “আবদাল” অর্থ বদলগণ। “বদল” অর্থ বিকল্প বিনিময়, বদলি। অর্থাৎ কিছু সংখ্যক নেককার মানুষ আছেন যাদের কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার “বদলে” অন্যকে আল্লাহ তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। এজন্য তাঁদেরকে “বদল” বা “আবদাল” বলা হয়। এ বিষয়ে বর্ণিত প্রতিটি হাদীসের সনদ বা সূত্র জঈফ বা দুর্বল। কোনো কোনো হাদীসের সনদে বা সূত্রে মিথ্যাবাদী রাবী বা বার্ণনাকারী রয়েছে।

এজন্য কোনো কোনো মুহাদ্দিস বা হাদীস বিশারদ এ সকল হাদীসকে বাতিল বা মাওযূ বলেছেন। আবার কেউ কেউ একাধিক সনদের কারণে এ হাদীসগুলোকে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। কেননা দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর অনেক তাবিয়ী, তাবে তাবিয়ী,মাহাদ্দিস, ইমাম ও ফকীহ “আবদাল” শব্দটি নিজেদের নামের সাথে ব্যবহার করেছেন।

অন্যান্য সকল বিষয়ের মত “আবদাল” বিষয়ে অনেক মিথ্যা কথা “হাদীস” বলে প্রচারিত হয়েছে। এ বিষয়ে নিম্নের তিনটি হাদীসকে কোনো কোনো মুহাদ্দীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করেছেন।

১ম হাদীস- শুরাইহ ইবনু উবাইদ (১০১হি) নামক একজন তাবিয়ী বলেন, হযরত আলী রা.-এর সাথে যখন মুআবিয়া রা.-এর যুদ্ধ চলছিল তখন আলী রা.-এর অনুসারী ইরাকবাসীগণ বলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! আপনি মুআবিয়ার অনুসারী সিরিয়াবাসীগণের জলব লা’নত বা অভিশাপ করুন। তখন আলী রা. বলেন, না। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি “আবদাল” বা “বদলগণ” সিরিয়ায় থাকবেন, তারা ৪০ জন ব্যক্তি। যখনই তাদের কেউ মৃত্যুবরণ করেন তখনই আল্লাহ তার বদলে অন্য ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করেন।

তাদের কারণে আল্লাহ বৃষ্টি প্রদান করেন। তাদের কারণে শত্রুর ওপর বিজয় প্রদান করেন। তাদের কারণে সিরিয়াবাসীদের উপর থেকে আল্লাহ আজাব দূরীভুত করবেন।

ইমাম যিয়া মাকদিসী রা. বলেন, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সূত্রে এ হাদীসটি আলী রা. এর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হাদীসটি “মাওকূফ” হাদীস হিসেবে সহীহ। (মুসনাদে আহমাদ- ১/১১২, ইমাম যিয়া মাকদিসী, আল-আহাদীস আল-মাখতারাহ- ২/১১০-১১২)

২য় হাদীস- তাবিয়ী আব্দুল ওয়াহিদ ইবনু কায়েস বলেন, উবাদা ইবনু সামিত রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এ উম্মতের মধ্যে “আবদাল” বা বদলগণ ত্রিশ ব্যক্তি। এরা দয়ালু আল্লাহর খালীল ইবরাহীম আঃ এর মতো হবেন। যখন এদের কেউ মৃত্যুবরণ করেন, আল্লাহ তার বদলে অন্য ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন।

কোনো কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে গ্রহণযোগ্য ও “হাসান” পর্যায়ে বলেছেন। (মুসনাদে আহমদ-৫/৩২২, মাজমাউয যাওয়াইদ- ১০/৬২-৬৪)

৩য় হাদীস- আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যমীন/পৃথিবী কখনো ৪০ ব্যক্তি থেকে শূন্য হবে না। যারা দয়ালু আল্লাহর খালীল ইবরাহীম আঃ. এর মতো হবেন, তাদের কারণেই তোমরা বৃষ্টি প্রাপ্ত হও এবং তাদের কারণেই তোমরা বিজয় লাভ কর। তাদের মধ্যে থেকে কেউ মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তার বদলে অন্য ব্যক্তিকে স্থলাভিষিক্ত করেন।

আল্লামা হাইসামী হাদীসটিকে “হাসান” বলে গণ্য করেছেন। (তাবারাণী আল মু’জামুল আওসাত্ব- ৪/২৪৭, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ- ১০/৬৩)

উপরের তিনটি হাদীস ছাড়াও আরও কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা অত্যন্ত যইফ হলেও সামগ্রিকভাবে “আবদাল”এর অস্তিত্ব প্রমাণিত। স্বভাবতই এ প্রমাণিত বিষয়কে কেন্দ্র করে অনেক জাল বানোয়াট ও মিথ্যা কথা প্রচলন করা হয়েছে।

“আবদাল” বা “বদল”গণের নিচের ও উপরের অনেক বানোয়াট পদ-পদবীর নাম বলা হয়েছে। যেমন ৩০০ জন নকীব/ নুকাবা, ৭০ জন নাজীব/নুজাবা, ৪০ জন বদল/আবদাল, ৪ জন আমীদ/ উমাদা, ১ জন কুতুব বা গওস ইত্যাদি। “আবদাল” ছাড়া বাকী সকল নাম উপাধি ও সংখ্যা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।

রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত কোনো একটি সহীহ বা যইফ সনদে বা সূত্রেও কুতুব, গওস, নজীব, নকীব, আওতাদ, আকতাব, আমীদ ইত্যাদিও কথা কোনোভাবেই বর্ণিত হয়নি। যদিও গত শতাব্দীতে কোনো কোনো আলিম এ বিষয়ে অনেক কিছু লিখেছেন। (ইমাম ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূআত- ২/৩৩৫-৩৩৭, ইমাম ইবনুল কাইয়িম, আল মানার- ১৩৬ পৃ, ইমাম যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল-৫/৬৪, ইমাম হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ- ১০/৬১-৬৩)

লেখক : শাইখ আখতারুজ্জামান খালেদ, ইমাম ও খতীব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button