
আব্দুর রহমান মিল্টন, ঝিনাইদহের চোখঃ
চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে ঝিনাইদহ সরকারী ভেটেরিনারি কলেজটি । ফলে ৫বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩’শর বেশী শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতও এখন অন্ধকারের দিকে চলেছে । যবিপ্রবি অনুষদভুক্তির দাবিতে কলেজটিতে শিক্ষার্থীরা বছরের পর বছর আন্দোলন চালিয়ে আসছে। আর এখন রীতিমতো তা অচল অবস্থায় পড়েছে । শিক্ষার্থীদের অব্যহত এই দাবির মুখে কর্তৃপক্ষ ১মার্চ থেকে কলেজটি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করে। এক জরুরী নির্দেশে আবাসিক শিক্ষার্থীদেরও হল ত্যাগ করতে হয়। কর্তৃপক্ষ পুলিশ নিয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়া সহ কলেজ বন্ধ ঘোষনা করে পরিস্থিতি সামাল দেয় । কোন রকম পূর্ব ঘোষনা ছাড়া এমন সব আদেশে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা আবাসিক শিক্ষার্থীরা পড়ে চরম বিপাকে। এমন সব পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে অত্যাধুনিক অবকাঠামো নিয়ে ঝিনাইদহ জেলা শহরের অদুরে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠা এই সরকারী ভেটেরিনারি কলেজটির ভবিষ্যত কি ? তাছাড়া অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে এগিয়ে চলা শংকিত শিক্ষার্থীদের দাবিই বা কোন পথে ? এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদভুক্তির বিষয়টি এবং এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কলেজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করলে, তারপর যবিপ্রবি অনুষদভুক্ত করা সম্ভব হবে কর্তৃপক্ষ বলছেন ।
জানা গেছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাঁচ বছর আগে স্থাপন করা হয় ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেরিনারি কলেজ। বর্তমানে এই কলেজে ৬টি ব্যাচে সাড়ে ৩শ’ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। কলেজকে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) অনুষদভুক্ত করার দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু সেই দাবি বাস্তবায়ন হয়নি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প চলমান থাকায়। কিন্তু গত ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তারপরও মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি। এজন্য যবিপ্রবি অনুষদভুক্ত কিংবা স্বতন্ত্র কলেজ হিসেবে এগোতে পারছে না, পড়েছে অচলাবস্থার মুখে ।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, ‘ঝিনাইদহ ভেটেরিনারি কলেজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। সেখানকার শিক্ষার্থীদের অনেক দিনের দাবি অনুষদভুক্ত করার। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, রিজেন্টবোর্ডের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। আমাদের দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। বাকিটা প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। তারা কলেজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করলে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদভুক্ত হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে পরিচালিত হবে। লেখাপড়ার মানও বাড়বে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা মহাসড়কের হলিধানীতে ঝিনাইদহ সরকারি ভেটেনারি কলেজ স্থাপন প্রকল্প শুরু হয়। ওইবছর শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম শুরু এবং কলেজটি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। বর্তমানে ৬টি ব্যাচে ৩৫০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়টির কলেজ স্থাপন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনো কলেজটি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদভুক্ত করা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, যবিপ্রবি অনুষদভুক্ত করার দাবিতে ভেটেরিনারি কলেজে শিক্ষার্থীরা বছরের পর বছর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছে । ক্যাম্পাসে মিছিল, মিটিং, সমাবেশ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান সহ দাবি আদায়ে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। আর ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কলেজ টি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প মুক্ত বা তাদের মেয়াদ শেষ হলেও তারা কলেজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করছে না । ফলে মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে তা যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদভুক্তও হচ্ছে না । এসব কারণে সাম্প্রতি শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ, হতাশা চরমে পৌছেছে । গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ফের আন্দোলন শুরু করেছে কলেজটির সাড়ে ৩’শর বেশী শিক্ষার্থী। তারা প্রধান ফটক সহ সকল কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয়, বিক্ষোভ প্রদর্শন করে । এই আন্দোলনের একপর্যায়ে কোন পূর্ব ঘোষনা ছাড়ায় ১ মার্চ কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা জাতির জনকের সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে সামনে নিয়ে, দক্ষ প্রাণী চিকিৎসক হওয়ার আশায় এই কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তবে তাদের সে স্বপ্ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ২০১৪ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের আওতায় কলেজিটির যাত্রা শুরু হয় কিন্তু প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আন্ডারগ্রাজুয়েশন লেভেল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার আইনি কোনো বৈধতা নেই। আবার কলেজটি পরিচালনার কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও নেই। যার ফলে শিক্ষাকার্যক্রম শুরুতেই নানা সমস্যার সম্মুখিন শিক্ষার্থীরা।
কলেজটিতে সুন্দর অকাঠামো আছে। কিন্তু দক্ষ ও পর্যাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণের অভাব রয়েছে। ল্যাবরেটরি আছে, রিঅ্যাজেন্ট (রাসায়নিক উপকরণ) নেই। এমন নানান সংকটও বিরাজমান রয়েছে ।
শিক্ষার্থীরা আরও জানান, বিশ্ববিদ্যালয় সমমর্যাদার এই কলেজটিতে কোনো অধ্যাপক কিংবা সহযোগী অধ্যাপক নেই। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের জেলা ও উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন ও অতিথি শিক্ষক দিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ফলে সেশন জট বাড়ছে। ইন্টার্ন প্রাণী চিকিৎসকদের কোনো সম্মানি ভাতার ব্যবস্থা নেই। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় কলেজে সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অতি সাম্প্রতি কলেজটি যবিপ্রবি অনুষদভুক্ত করার দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু হলে প্রশাসনের সহায়তায় গত ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে শিক্ষার্থীরা । সেশনজট আরও বাড়বে বলে অভিযোগ তাদের। এমন অবস্থায় ভবিষৎ নিয়েও শংকা প্রকাশ করেন কলেজটির শিক্ষাথী প্রনব সাহা, ইসরাত জাহান সহ অনেকে।
এসব প্রসঙ্গে ঝিনাইদহ ভেটেরিনারি কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) ড. অমলেন্দু ঘোষ বলেন, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি লিখিতভাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়েছে। এরপর মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদভুক্তি। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কলেজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করলে, তারপর যবিপ্রবি অনুষদভুক্ত করা সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের মুল দাবি সংক্রান্ত আন্দোলন যৌক্তিক তবে তা ভিন্নখাতে প্রবাহিত হওয়ায় প্রশাসনের সহায়তায় হল খালি ও কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝিনাইদহে গড়ে ওঠা অমিত সম্ভাবনাময় কলেজটি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদ হিসাবে ঘোষনা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে দক্ষ প্রাণী চিকিৎসক গড়ার কারিগর হিসাবে খ্যাতি পাবে শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের পাশাপাশি এমনটি প্রত্যাশা করছে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষও ।