জানা-অজানা

কিডনি রোগ প্রতিরোধে কী করবেন?

ঝিনাইদহের চোখঃ

রাজধানীর আশকোনার বাসিন্দা আবদুস সাত্তার। সাড়ে তিন বছর আগে স্ত্রী নূরজাহান বেগমের কিডনি রোগ ধরা পড়ে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুটি কিডনিই বিকল হয়। এরপর থেকে আবদুস সাত্তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ডায়ালাইসিস সেন্টারে ছুটেছেন।

স্ত্রীর পেছনে ৬০-৭০ লাখ টাকা খরচ করেও শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেননি। মাস চারেক আগে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নূরজাহান বেগম।

আবদুস সাত্তারের বড় ছেলে নুরুল আলম লিটন। তিনি জানান, একটি পরিবারে একজন কিডনি বিকল রোগী থাকলে সব ধরনের সুখ-শান্তি, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম হারাম হয়ে যায়। চিকিৎসা দিতে কত ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হয়, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্সের অভাব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন পরিবারটির সবাই। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলছিলেন, কিডনি বিকল যেন শত্রুরও না হয়।

আবদুস সাত্তারের স্ত্রীর বাস্তব জীবনের এ গল্প যেন দেশের লাখ লাখ কিডনি বিকল রোগীর। দেশে বর্তমানে কিডনি রোগীর সংখ্যা কত- এ সম্পর্কে কোনো জাতীয় জরিপ না থাকলেও অনুমিত পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে বর্তমানে কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। কিডনির বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রতি বছর কিডনি বিকল হয় ৩০-৪০ হাজার রোগীর। এ ধরনের রোগীদের নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি প্রতিস্থাপন করে বেঁচে থাকতে হয়। উভয় প্রকারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় এ ধরনের রোগীদের শতকরা ৮০-৯০ ভাগ বিনা চিকিৎসায় মারা যান।

কিডনি ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশীদ বলেন, কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। বর্তমানে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের কিডনি ফেইলিউরের ঝুঁকি বেশি।

তিনি বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে ৫০ ভাগ কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে দেশের ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক। পাশাপাশি বেশি বেশি নার্স, প্যারামেডিক্স ও কিডনি বিশেষজ্ঞ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।

তিনি আরও বলেন, দেশের ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন চিকিৎসা নেয়। এসব মানুষের রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রয়েছে কিনা, প্রস্রাবের সঙ্গে মাইক্রো অ্যালবুমিন বা অ্যালবুমিন যাচ্ছে কিনা- তা যদি জানা যায়, তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগ শনাক্ত করা যায়। এরপর তাদের যথাযথ চিকিৎসা দিলে ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে ক্রনিক কিডনি রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ বিষয়ে নজর দেয়া জরুরি।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেজ অ্যান্ড নিউরোলজি হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. ফিরোজ খান ও বেসরকারি ইনসাফ বারাকাহ কিডনি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রখ্যাত ইউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. এম ফকরুল ইসলাম অভিন্ন সুরে বলেন, বেশির ভাগ কিডনি রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কিডনি বিকল হওয়ার শেষ পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত রোগটি ধরা পড়ে না। ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে সচেতনতার অভাবে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার এমনকি শিক্ষিত মানুষও আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, বছরে দু’বার ইউরিন, এস ক্রিয়েটিনিন, ইজিএফআরন ও আলট্রাসনোগ্রাম অব কেইউবি– এ কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনি ভালো আছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।

বর্তমানে ৮০ লাখ লোক ডায়াবেটিসে, দুই কোটি লোক উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। এ কারণে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসা ও সচেতনতা জরুরি। এ রোগ প্রতিরোধে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটা, অতিরিক্ত লবণ পরিত্যাগ, হরহামেশা ব্যথানাশক ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন, ফাস্টফুড, চর্বিজাতীয় ও ভেজাল খাবার, ধূমপান বর্জন করা উচিত।

এছাড়া কারও কিডনি রোগ হোক বা না হোক বছরে অন্তত একবার কিডনি ফাংশন পরীক্ষা করা উচিত।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button