শুভ জন্মদিন যমুনা টেলিভিশন
মুরশিদুজ্জামান হিমু, ঝিনাইদহের চোখঃ
বাঙালি আবেগের জাতি। আবেগের তেমন কোন উপলক্ষ্যও লাগে না। ধরুন, একটু বৃষ্টি হলে আবেগ আসে, একটু বেশি রোদ হলে। আবার খুব সকালে ঘুম ভাঙলে, কিংবা ঘুমোতে খুব রাত হয়ে গেলে। আর কখনও ঘণ্টা চুক্তিতে রিকশায় চড়লে তো কথাই নেই।
আজ আমিও একটু আবেগি। তবে, রোদ, বৃষ্টি কিংবা রিকশায় ঘোরার মত কোন বিষয় মনে করে নয়। তবে অবশ্যই পুরনো গল্প মনে করে। একটি চার তলা ভবনে পাঁচটি বছর কাটিয়ে দেয়ার অনেক গল্প মনে করে। কত হাসি, কত গল্প, হই-হুল্লোড়, উৎকণ্ঠা। এ ফ্লোর থেকে ও ফ্লোর দৌঁড়াদৌড়ি। মাঝে মাঝে চোখ বুজে ভাবি, নাহ্ মন্দ যায়নি সময়গুলো। বলাই তো হল না, এত স্মৃতির ঝুড়ি নিয়ে লিখতে বসার কারণ, যমুনা টেলিভিশনের জন্মদিন।
শুরুতে কি অন্ধকার অন্ধকারই না লাগত। ফাঁকা অফিস, লোকজন তেমন নেই। শুরুতে যে ক’জন ছিলাম, তাদের নিয়েই সকালে এসে চায়ের আড্ডা শুরু হত। চলত দুপুর পর্যন্ত। দুপুরে খাবার বিরতিতে আড্ডা থামত না। খাবার পর আবার চা, কখনও কফি। এ গল্প-সে গল্প হতে হতে সন্ধ্যা। এমন কত শত আড্ডা আর প্রস্তুতির মাঝেই ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল অনএয়ার হল যমুনা টেলিভিশন। কত মানুষের কত শঙ্কা জাগানিয়া কথা। এই আসবে তো যমুনা? শুনলাম, আবার কি নাকি ঝামেলা? ভুল করলে নাতো? এমন হাজারো প্রশ্নের দু-একটি যে কখনও নিজেকে ছোঁয়নি, তা নয়। কিন্তু খানিকক্ষণ বাদেই তা উবে গেছে, চোখের সামনে কিছু মানুষের বিরামহীন প্রচেষ্টা দেখে। তখন মনে হত, ঠেকায় কে? আসলেই তো। যমুনাকে ঠেকায় কে? সাধ্য কার?
আসলে এই লেখাকে স্মৃতিকথা বলা যায়। লিখতে গিয়ে বুঝছি, এমন লেখার ভার কত। পুরোটাই স্মৃতির ভার। এতো ভার আমি বয়ে নিয়ে বেড়াই প্রতিক্ষণ?
যাক স্মৃতির ভাণ্ডার নিয়ে যেহেতু বসেছি, প্রথম দিনগুলোর কথা কিছু বলি। বসন্তের শেষের দিকে বৈশাখের দ্বারপ্রান্তের এক সন্ধ্যায় ইথারে ভাসলো যমুনার ফ্রিকোয়েন্সি। আহা, কী মধুর ছিল সেই দিনটি। কিছুটা নির্ভার হওয়ারও। আবার দায়িত্বও যে সবার কাধে চেপে বসেছে, তাও ভোলেনি কেউ। এভাবেই দিনের পর দিন এগিয়ে চলল। এই যমুনাই কতশত সুখের খবর দিল। এই যমুনা-ই আবার দিল কত মন খারাপ করা খবর। কিন্তু সংবাদকর্মী হিসেবে যে সেসব দেখার সুযোগ কই। যেটা নিউজ, সেটা নিউজই। এখানে আবেগাক্রান্ত হওয়ার সুযোগ যে নেই।
মনে পড়ছে, সম্ভবত প্রথম আমরা বড় নিউজ ইভেন্ট পেলাম নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা। সবার আগে সে খবর চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ আর ক্রসচেক করে যমুনাই সবার আগে প্রচার করে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সেদিন আমরা দীর্ঘসময় সরাসরি সম্প্রচারে ছিলাম। দেখিয়েছিলাম সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত। সেই নিউজ কাভারেজকে বলব, ‘মর্নিং শো’জ দ্য ডে’। অর্থাৎ, সে ঘটনার পর থেকে অনেকেই বুঝে গেছেন, যমুনা হুট করে আসা কিছু নয়। এই টেলিভিশন থাকতে এসেছে, এসেছে মানুষের মন জয় করতে। মানুষ যা দেখতে চায়, তাই যেমন দেখায় যমুনা টেলিভিশন। আবার যা মানুষের দেখা দরকার, সম্প্রচার করে তাও।
যমুনার সংবাদকর্মীরা জানে, তাদের কাঁধে পাহাড় সমান দায়িত্ব। যে দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে শুধু টেলিভিশনের জন্যই নয়, আরও বৃহত্তর স্বার্থে। দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে।
যেখানেই খবরের গন্ধ পেয়েছে যমুনার অনুসন্ধিৎসু মনের সাংবাদিকরা, সেখানেই ছুটে গেছে। কী রাত-ভোর, কী ঝড়-বাদল। কোন কিছুই কখনই ছিল না বাধা। এর জন্য কম খেসারতও দিতে হয় নি তাদের। মনে পড়ছে, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পলিথিন নিয়ে সবিস্তার বিশেষ রিপোর্ট করতে গিয়ে কী নির্মম হামলার শিকার-ই না হতে হয়েছে আমার সহকর্মীকে। পাথর খেঁকোদের হামলা তো রীতিমত রক্তাক্ত করেছে আমার সহকর্মী ভাইকে। ছাড়েনি ইন্টার্ন চিকিৎসকরাও। তাদের করা মাথায় আঘাতের ক্ষত অনেকদিন বয়ে বেড়াতে হয়েছে যমুনার সংবাদকর্মীকে। ভোটের খবর কাভার করতে গিয়ে একসাথে আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীর ওপরও আঘাত এসেছে। মাদক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দুর্বৃত্তের হামলার শিকার আমার সহকর্মীরা। সেই ক্ষত তো এখনও দগদগে। এছাড়া ফোনে হুমকি-ধামকি, এমন ঘটনাতো কললিস্ট ঘাটলেই বের হয়। কিন্তু তাতে কি পিছিয়ে পড়তে পারে যমুনার সংবাদ কর্মীরা? এর উত্তর বোধহয় আমরা যারা নিত্যদিন সংবাদের সাথে কাজ করি, তারা খুব ভালোভাবেই জানি। এককথায় যদি বলি, না।
এই যমুনা কত মানুষকেই না আশার আলো দেখাল। অন্ধকার জগৎ থেকে ফেরাল আলোঝলমলে পৃথিবীতে। সুন্দরবন এখন সেই আগের সুন্দরবন নেই। নেই দস্যুদের আনাগোনা। জেলে-বাওয়ালীদের নিরাপদ অভায়ারণ্য এখন ম্যানগ্রোভ বনটি। একে একে অস্ত্রসহ দস্যুবাহিনীর আত্মসমর্পণের পেছনে যে হাজারো গল্প। চোখ বুজে যখন ভাবি, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ হয়েছে যমুনার হাত ধরে, বুকটা গর্বে ভরে ওঠে।
এমন কত ঘটনা, কত গল্প বলব? এতো ফুরাবার নয়। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি। একসাথে এসে সব ভিড় করছে মস্তিষ্কে।
ইট-পাথরের শহরে মায়া নাকি ঠুনকো। কিছু জায়গায় সত্য হলেও আবার কিছু জায়গায় তা ডাহা মিথ্যা। যেমন যমুনা টেলিভিশনের এই কনক্রিটের ভবনের কথাই বলি। এই ভবনে আমাদের কত মায়া। প্রতিটি দিন যায়, বাড়ে গল্পের সংখ্যা। প্রায়ই ভাবি, এই গল্প তো ফুরাবার নয় কখনও। দেবিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘যে গল্পের শেষ নেই’।
গল্পের ভাণ্ডার বাড়ুক। আরও পূর্ণ হোক স্মৃতির থলি। এগিয়ে যাক যমুনা টেলিভিশন। জন্মদিনের এই শুভক্ষণে এই তো চাওয়া।