বিশ্বজয়ী পতাকা কন্যা
ঝিনাইদহের চোখঃ
পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে একাই ছুটে বেড়ান বাংলাদেশের এক সাহসী কন্যা। প্রকৃতির প্রেমে পড়েছিলেন সেই ছোটবেলাতেই। উৎসাহ দিয়েছিলেন বাবা। শুরুটা হয়েছিল ২০০০ সালে। পাশের দেশ ভারত ভ্রমণের মধ্য দিয়ে। এ পর্যন্ত ঘুরেছেন ১২৫টি দেশ। লক্ষ্য আরো বিশাল। পৃথিবীর সব দেশে পড়বে তাঁর পা। সেই লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক ছুটে চলা।
“আমার অর্থ নেই, সম্পদ নেই, এমনকি আমার স্বর্ণালঙ্কারও নেই কিন্তু আমার ইচ্ছা শক্তিই আমাকে পৃথিবীর পথে প্রান্তরে নিয়ে যাচ্ছে। আমার জন্মই হলো ভ্রমণ করার জন্য। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আমার পছন্দ।“ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন নাজমুন নাহার। যিনি জাম্বিয়া সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন ‘ফ্ল্যাগ গার্ল’ উপাধি। পৃথিবীর হাজার সাতেক শহর ঘুরেছেন এ অবধি। যত না দেখেছেন তারচেয়ে শিখেছেন অনেক বেশি।
তার প্রমাণ পাওয়া গেল তার সাথে কথা বলেই। অদ্ভুত সুন্দর হাসেন মানুষটি। প্রথম সাক্ষাতেই একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। আলাপ শুরু করলাম তার সাথে। তখনো বুঝতে পারিনি আলাপ চলবে প্রায় ঘন্টা পাঁচেক। যিনি পৃথিবীর ১২৫টি দেশ ঘুরেছেন তার সাথে গল্প কি আর শেষ হয়!
শুরুতেই জানতে চাইলাম কেন আগ্রহী হলেন বিশ্ব ভ্রমণে? অকপট উত্তর, “ ভালবাসা থেকে। প্রকৃতি ভালবাসি আমি। সেই ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব টান অনুভব করি রক্তের ভেতরে। আব্বাও আমাকে বেশ উৎসাহ দিয়েছিলেন। আর এখন তো মনে হয় আমার জন্মই হয়েছে পৃথিবী দেখার জন্য।“
কথায় কথায় জানা গেল একটু আগেই ফিরেছেন নিজ শহর লক্ষ্মীপুর থেকে একটা সংবর্ধনায় গিয়েছিলেন। শ্রান্ত ক্লান্ত মানুষটি কথা বলে চলেছেন এক নাগাড়ে। যেন আমাদেরকেও নিয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর আনাচে কানাচে। কখন্ব কঙ্গো, কখনও ঘানা কখনওবা দক্ষিণ আফ্রিকায় মৃত্যুর হার থেকে ফিরে আসার গল্প। আমরা তন্ময় হয়েই শুনছিলাম তার কথা। বিশ্বের এতগুলো দেশ পাড়ি দিয়েছেন বিপদেও তো পড়েছেন নিশ্চয়ই? এমনটাই চাইলাম জানতে। বললেন, “বিপদ তো পদে পদেই ছিল। মৃত্যুও হতে পারতো কয়েকবার। কত ঘটনা বলবো । অনেক অনেক ঘটনা আছে এমন। তবে মানুষের ভালবাসা আর স্রষ্টার করুণায় ফিরেও এসেছি বারবার। “
আলাপে আলাপে জানাগেল এমন অনেক ঘটনাই। গিনি বিসাউ থেকে যাবেন গিনি কোনাক্রি। ৯ ঘন্টার পথ। কিন্তু পথের এমন দশা যে একে পথ না বলাই শ্রেয়। যেমন পাথুরে এমন ভাঙাচুরো আর রুক্ষ। আর যে গাড়িতে উঠেছেন সেটিকেও ঠিক গাড়ি বলা যাবে কী না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এমন একটি গাড়ি যার দরজা লাগাতেও হয় স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে আবার খুলতেও হয় তা দিয়ে। এছাড়া বিকল্প কিছুও নেই এ পথে যাবার। যাচ্ছেন তো যাচ্ছেনই। ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পথ। যেন শেষই হতে চায় না। দূর থেকে ভেসে আসে নানান হিংস্র পশুর ডাক। একটু পর পর গাড়ি যাচ্ছে নষত হয়ে। তবুও তিনি ছুটছেন। যত কষ্টই হোক লক্ষ্য অর্জন করা চাই। তিনি একা একজন নারী হয়ে সারা বিশ্ব ঘুরবেন এইতো তার স্বপ্ন। হুট করে আবার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। এবার একেবারেই নষ্ট হয়েছে। ড্রাইভার অনেক চেষ্টা করেও ঠিক করতে পারলো না।
এদিকে রাত হয়ে গেছে। জঙ্গলের মধ্যে যাবারও পথ নেই। সঙ্গে থাকা কয়েকজন স্থানীয় মানুষকে নিয়েও হাঁটা পথ ধরলেন তিনি। ফোনে নেই চার্জ। কারও সাথে যোগাযোগ করারপ্ব উপায় নেই। এদিকে আবার ক্ষুধা তৃষ্ণায় এতটাই কাতর হয়ে গেছেন যে ঠিকমতো হাঁটতেও পারছিলেন না। হঠাৎই চোখের সামনে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর দেখতে পেলেন। সেই ঘরের বাইরে কয়েকটি পাথর রাখা ছিল সেখানেই গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
বাড়িতে একজন মহিলা ছিলেন যিনি বের হয়ে এলেন। কেউ কারও ভাষা বোঝেন না। তবুও অর্থ বিত্তহীন সেই নারীর কোমল হৃদয়ের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন। তিনি তাকে ঘরে নিয়ে বসালেন। যদিও তার ঘরে কোন খাবার বা পানীয় ছিলনা তবুও তার যত্ন নেবার চেষ্টা করলেন। এখানে দীর্ঘ ২৯ ঘন্টা আটকে থাকার পর তাদের গাড়ি ঠিক হয়েছিল। সেই ২৯ ঘন্টায় তিনি শুধু মাত্র এক টুকরো আলু খেয়ে বেঁচে ছিলেন।
এমনই আরেক ঘটনা ঘটেছিল উগান্ডা থেকে রুয়ান্ডা যাবার পথে। সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টিতে আটকে ছিলেন এক বৃক্ষের নিচে। বেশ ভয়ই পেয়েছিলেন সেদিনটিতে। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণও ছিল। যে জায়গায় আটকে ছিলেন সেটার বেশ দুর্নামও ছিল ছিনতাইয়ের।
আবার মজার অভিজ্ঞতার ঝুলিও কম ভরা না তার। বতসোয়ানার ফ্রান্সিস টাউন যাবার কালে মানুষের ভালবাস্য সিক্ত হয়েছেন তিনি। পেয়েছেন অসংক্য স্মৃতিপত্র, স্মারক অনেক জিনিসও। সবচেয়ে বেশি যা পেয়েছেন তা হলো পৃথিবী জুড়েই আছে তার বন্ধু বান্ধব। স্কুল ড্রপার ফ্রিদা, জোহানাসবার্গের উপকারী বন্ধু ইতুমেলেং, জাম্বিয়ান মেয়ে এঞ্জেলিকা, কঙ্গোর মার্গারেট, অস্ট্রেলিয়ার স্কা, গাম্বিয়ার সাফিলো-বিন্তা দম্পতি কিংবা সিয়েরা লিয়নের ডোরা। এরকম বহু মানুষ আছে যারা নিয়মিত তার খোঁজ খবর রাখেন।
সবচেয়ে আনন্দ পান যখন দেখেন তাকে দেখে কেউ উৎসাহী হচ্ছে নিজের বন্দীত্ব ভাঙতে। আইভরি কোস্টের মেয়ে ইভানাতো তার কারণে আত্মহত্যার হাত থেকে ফিরে এসেছে। নতুন করে স্বপ্ন দেখছে এখন সে। নিজেকে মেয়ে না ভেবে মানুষ হিসেবেই ভাবেন বেশি। ভাবনাটার প্রতিফলনও তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। আত্মনির্ভরশীল একজন মানুষ হিসেবে অনুপ্রেরণা খুঁজে পান মাদার তেরেসার জীবন থেকে। জীবন শেষে সব অর্থ সম্পদ বিলিয়ে দিতে চান পথ শিশুদের মাঝে। দিনশেষে তাদের জন্য একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে যেতে চান। গড়তে চান নিজের বিশ্ব ভ্রমণের সংগ্রহ দিয়ে একটা জাদুঘর। শুধু জাদুঘরই থাকবেনা। মানুষের জন্য কাজ করবে এমন একটা কিছুই যেন হয় তাই আশা তার।
এত যে দেশ ঘুরলেন টাকার উৎস কী? প্রশ্ন করলাম। হেসে উঠলেন । বললেন, “সবচেয়ে বেশি মুখোমুখি হতে হয়েছে এই প্রশ্নের। এর উত্তরটা অনেক সহজ। কাজ করে করে টাকা জমাই। সেই টাকা হিসেব করে খরচ করেই আমি ভ্রমণে বের হই।“
আলাপে আলাপে জানালেন বই পড়ার কথা । বাবা উপহার হিসেবে সবসময়ই বই দিতেন। একসময় নিজেকে আবিষ্কার করলেন বইয়ের পোকা হিসেবে। মূলত বইয়ের জগতের মধ্য দিয়েই প্রকৃতির প্রতি আকর্ষণের জন্ম। দাদা হজ্বে গিয়ে আরবের অনেক দেশ ভ্রমণ করে এসছিলেন। সেটা ১৯২৬-১৯৩১ সালের ঘটনা। সেই গল্পও তাকে টেনেছে ছোটবেলায়।
ভ্রমণের শুরুটা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। ২০০০ সালের শুরুর দিকের কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছেন মাত্র। সুযোগ এলো ভারতে যাবার। ৮০টি দেশের গার্লস গাইড আর স্কাউট সম্মেলন। সেখানে দেশের হয়ে পতাকা উড়নোর দায়িত্ব পড়লো তাঁর কাঁধে। অদ্ভুত ভাল লাগার একটা শিহরণ বয়ে গেল শরীরে। নিজের দেশের পতাকা অন্য দেশের মাটিতে উড়ানোর সুখ পেলেন মনে প্রাণে। ভারতের মধ্যপ্রদেশের পাচমারিতে কাটানো ১৫টি দিন তাঁর স্বপ্নটাকে করে তুলল আরো বিশাল। আরো বিস্তৃত। ভাবলেন বিশ্বের সব দেশে যদি নিজের দেশের পতাকা উড়তে পারতাম।
মোহাম্মদ আমীন ও তাহেরা আমীন দম্পত্তির আট সন্তানের ছোট সন্তান তিনি। বাবাকে হারিয়েছেন ২০১০ সালে। মাথার উপর সবসময়ের ছায়াটা সরে গেলেও থেমে থাকেনি তাঁর গল্প। বাবাকে হারিয়ে মায়ের সাথে সময় কাটানোটা বেড়েছে। মাকে নিয়ে ১৪টি দেশও ভ্রমণ করেছেন।
বসবাস করছেন সুইডেনে। পড়াশোনার সুবাদে পাড়ি জমানো। তারপর থিতু হওয়া। সুইডেনের ল্যুন বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ শুরু করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। টাকা জমানোর চিন্তাটা তখনই। গ্রীষ্মের ছুটি শেষে বেশ অংকের একটা টাকা জমতো সেই টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তারপরের গল্প শুধুই ছুটে চলার। পাহাড় পেরিয়ে সাগর, মরুভূমি, গ্রাম , শহর সব চষে বেড়াচ্ছেন। পুরো পৃথিবীতেই পা ফেলার স্বপ্ন তাঁর।
১০০তম দেশ হিসেবে পা ফেলেছেন জিম্বাবুয়েতে। সেখানে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের কাছে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল পুরো বাংলাদশ আছে তার সাথে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কথা মনে পড়ছিল বেশি। যারা একটি পতাকা দিয়ে গেছেন। সেই পতাকাকেই উড়িয়েছেন বিশ্বের ১০০টি দেশে। এ অররজন যেন তার একার নয়। এ অররজনের ভাগতো মুক্তিযোদ্ধাদেরও আছে।
পতাকা উড়াতে গিয়ে ভালবাসাও পেয়েছেন দেশের মানুষের। সিয়েরালিয়নের সৈকতে উড়াচ্ছিলেন বাংলাদেশের পতাকা। দুইজন দৌড়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন তিনি বাংলাদেশি কীনা। উত্তর পাবার পর দুজনই কেঁদে ফেললো। তারা বাংলাদেশি। এবং জানা গেল এখানে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি আছে। বিশাল এক কমুনিটিতে নিয়ে গেল তারা। অনেকদিনপর দেশীয় রান্না মুখে দিয়ে কান্না চলে এসেছিল তার।
ঘুরতে ঘুরতে দেখেছেন বিচিত্র সব মানুষ। বিচিত্র তাদের জীবনাচার। আস্তে আস্তে উপলব্ধির জগতটা প্রশস্ত হয়ে আকাশের মতন। সব উপলব্ধি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেই হাতে নিয়েছেন কলম। লিখতে শুরু করেছেন তাঁর ভ্রমণ কাহিনীর ইতিবৃত্ত।
জানতে চাইলাম সবচেয়ে ভালো লাগা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা। অকপটে বললেন ,”সব ভ্রমণই আমার কাছে সমান উপভোগ্য। তারপরও বিশেষ করে বলব চিলির মুনভ্যালির কথা। পৃথিবীর বুকে যেন এক খন্ড চাঁদ। কী অপূর্ব তাঁর রূপ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা। আমাকে বারবার টানে । আর আফ্রিকা আমার ভাল লেগেছে। বারবার যেতে চাই এখানে।“
প্রতিবন্ধকতাও এসেছে নানা রকম। ‘এত ঘুরে টাকা নষ্ট না করার’ পরামর্শ পেয়েছেন বহু জনের থেকে। গায়ে মাখেননি কারো কথাই। পরিবারের সদস্যদের অনুপ্রেরণাই তাকে এসবের হাত থেকে আগলে রেখেছে এখন অবধি। এখনো কত দেশ ঘোরা বাকী।
আরও অনেক গল্প বাকী রেখেই উঠতে হলো আমাদের। ক্লান্ত মানুষটির বিশ্রাম প্রয়োজন। তার সাথে বিদায় নেবার আগে আবদার রাখলাম “আপনার সাথে কোথাও ঘুরতে যেতে চাই। “ মৃদু হেসে সম্মতি দিলেন। সত্যিই তার সাথে ঘুরতে যেতে চাই। যার সাথে বসলে পুরো পৃথিবী ঘুরে আসা যায় গল্পে গল্পে তার সাথে ঘুরতে যাবার সুযোগ তো আর হারাতে পারিনা।