কালীগঞ্জটপ লিড

ঝিনাইদহে দারিদ্রতাকে জয় করতে চলেছে নারীরা

শাহজাহান আলী বিপাশ-

পিংকী দাসীর বাবা ভবেশ দাশ ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি। ৭ বছর আগে হঠাৎ তার মৃত্যুতে পিংকিসহ শিশু ২ পুত্র নিতাই আর গৌরকে নিয়ে চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েন মা শংকরী দাসী। নিরুপায় হয়ে সন্তানদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে মা একটি হোটেলে রান্নার কাজ নেন। এমন অবস্থার মধ্যদিয়ে বহু কষ্টে পিংকীকে বিয়েও দেন। কিন্ত মায়ের পক্ষে শ্বশুর বাড়ির লোকজনের দাবিকৃত জিনিসপত্র না দিতে পারায় স্বামীর সংসার ছেড়ে পিংকিকে আবার হতে হয়েছিল মায়ের ঘাড়ের বোঝা।

মধ্যবয়সী আলেয়া বেগমের স্বামী নিয়ামত আলী জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে ৫ বছর ধরে শয্যাশায়ী। সংসারের সম্পদ বলতে যা ছিল তার সবটুকুই প্রায় চলে গেছে তার চিকিৎসায়। এরপর অভাব কি জিনিস তা তিনি দেখেছেন। পরিবারের সদস্যদের দিন কেটেছে অনাহারে অর্ধাহারে থেকে। কোন পথ না পেয়ে একমাত্র ছেলে আশরাফুলের লেখাপড়াটাও বন্ধ করতে হয়েছিল।

দরিদ্র পরিবারের মেয়ে রিপ্তা খাতুন। বিয়ের পর থেকে ৬ বছর ধরে স্বামীসহ শশুর বাড়ির যৌতুক লোভী লোকজনের মুখের গালমন্দ শুনছেন। তাদের আর্থিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এক পর্যায়ে ২ সন্তানের জননী হয়েও ছাড়তে হয়েছে স্বামীর সংসার। কোন দিশা না পেয়ে একজন অসহায় মানুষ হিসাবে মাথা গুজে থাকার জন্য ঠাই হয়েছে ফুফু বাড়িতে।

শুধু পিংকী, আলেয়া, রিপ্তা নয় এমন দুঃখভরা অসহায় জীবনের গল্প শোনালেন আফরোজা, রাজিয়া, ডলি, রোজিনা, সাকিলা, লিপি, স্বপ্না, বিজলীসহ জীবনযুদ্ধে শামিল হওয়া অসহায় ২২ জন নারী। যারা সকলেই এখন ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বাকুলিয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ওয়েল সার্জিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় কাজ করেন। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে তৈরী করছেন সার্জিক্যাল চিকিৎসায় ব্যবহৃত কটন, গজ, ব্যানডেজ, প্যাড, সিজার বেল্ট, মাথা ব্যথায় ব্যবহৃত কোর সেট বেল্ট, গলার বেল্ট, আর্ম সেলিং ব্যান্ডেজসহ মানবদেহের বাহ্যিক চিকিৎসা সংক্রান্ত ১৪ প্রকার জিনিসপত্র।

সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, মেয়েরা কেউ বিভিন্ন প্রকার বেল্টের কাপড় কাটছেন, কেউ সেলাই করছেন, কেউ তৈরীকৃত জিসিপত্রের প্যাকিং করছেন। অন্যদিকে কেউ ঘুরে ঘুরে কাজ তদারকি করছেন। আবার তৈরীকৃত মাল বাজারজাত করতে কার্টুন ভরে নিয়ে যাচ্ছেন মার্কেটিংয়ে নিয়োগ প্রাপ্তরা। ফলে সবাই যেন নিজ নিজ কাজে মহাব্যস্ত।

কথা হয় এখানে কর্মরত বিজলী খাতুনের সাথে তিনি জানান, বেশ কিছুদিন আগে তার স্বামী মারা গেছে। স্বামীর সংসারে তেমন কিছুই নেই। তার একটা ছেলে রয়েছে। এতোদিন ভ্যানচালক বাবার ঘাড়ে বোঝা হয়ে ছিলেন। এরপর এখানে কাজ পেয়ে যা বেতন পাচ্ছেন তা দিয়ে এখন চলতে পারছেন। তিনি বলেন, এতোদিন হতাশার মধ্যে দিন কাটতো। এখন অন্তত দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে ছেলেটা মানুষ করার মত একটা পথ খুঁজে পেয়েছেন।

রোজিনা খাতুন জানান, সারাবছর সাংসারিক অভাব অনাটনের মধ্যদিয়ে জীবন চলতো। এখানে কাজ পেয়ে প্রতি মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন। যা দিয়ে তার সংসার চলছে। বাঁচতে পারছেন আত্ম সম্মান নিয়ে।

সাকিলা খাতুন জানান,এখানে যারা কাজ পেয়েছেন তারা সকলেই অসহায় হতদরিদ্র। আগে তাদের মত মহিলাদের কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকাসহ দেশের দুরদুরান্তের গামেণ্টসসহ বিভিন্ন কলকারখানায় যেতে হতো। কিন্ত এখন সংখ্যায় কম হলেও তারা বেশ কিছু মহিলা বাড়ি থেকে এসে এখানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন। তিনি জানান,এখানে যারা কাজ করেন তাদের কাজ খুব প্রয়োজন ছিল। তারা সকলেই মনে করেন কোম্পানী টিকে থাকলে তাদের কাজ থাকবে। ফলে তারা নিজেদের সংসারের কাজের মত যতœশীলভাবে কাজ করেন।

আলেয়া বেগম জানান, সমাজে তার মত অসহায় মেয়েদের সংখ্যা কম নয়। কিন্ত শত অভাব অনাটনের মধ্যেও অনেকে কাজ করতে এলাকা ছেড়ে দুরে কোথাও যেতে পারেন না। যে কারনে সরকারী উদ্যোগে অথবা বিত্তবান লোকেরা যদি এমন মফস্বল পর্যায়ে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তাহলে অসহায় নারীদের কর্মসংস্থান হবে। তাদেরকে অন্যের ঘাড়ের বোঝা হতে হবে না।

এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিএম সাইদুজ্জামান সবুজ জানান, তাদের এখানে কাজ করা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ মেয়েরই এ সকল জিনিস তৈরীর পূর্বে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। ঢাকা থেকে অভিজ্ঞদের এনে মাস ব্যাপী প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে তৈরী করেছেন। এখন তারা নিখুতভাবে কাজ করতে পারছেন।

তারা জানান, তাদের তৈরীকৃত জিসিপত্র খুলনা বিভাগের বেশিরভাগ জেলায় বাজারজাত করা হচ্ছে। গুণগত দিক ভালো হওয়ায় ক্রমেই মার্কেটে তাদের মালের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তারা বলেন, শুধু মুনাফা অর্জনই তাদের মূল লক্ষ্য না। সমাজের যে সমস্ত মেয়েরা বেশি হতদরিদ্র অসহায় যাদের কাজ খুব প্রয়োজন তাদেরকেই নিয়োগ দিয়েছেন। এতে একদিকে তারা মানবদেহের উপকারী জিনিস তৈরী করছেন অন্যদিকে এ এলাকার হতদরিদ্র অসহায় মহিলাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে এটাই বড় কথা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button