ঝিনাইদহ সদরটপ লিড

ঝিনাইদহের দলিত জনগোষ্ঠী আগের মতোই পিছিয়ে

মোঃ খলিলুর রহমান, ঝিনাইদহের চোখঃ

মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের দলিত সম্প্রদায় জাতপাত অস্পৃশ্যতার কারণে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। আধা কোটির উপরে দলিত জাতপাতের কারণে শতশত বছর ধরে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে শোষণ ও নিপীড়নের শিকার।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অস্পৃশ্যতার গ্লানি নিয়ে তাদের সমাজে সবচেয়ে নিচু শ্রেণির মানুষের পরিচয়ে পরিচিত করে এবং তারা বঞ্চিত হয় মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে। পেশাজীবী পরিচ্ছন্নকর্মীরা শিক্ষিত হলেও জাতপাত বৈষম্যেও কারণে অন্য পেশায় অংশগ্রহণ বা টিকতে পারেনা। যথেষ্ট যোগ্য বা শিক্ষিত হলেও সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে আবেদনকারীকে শুধু পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে যোগ্য বলে ধরা হয়।

ঝিনাইদহ জেলার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে দলিত সম্প্রদায়ের লোকজনদের সাথে কথা বলে তাদের অনেক কষ্ট ও অনুভূতির কথা জানা সম্ভব হয়েছে। ঝিনাইদহ জেলার ঝিনাইদহ সদও উপজেলার উত্তর কাষ্টসাগরা গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কেতু অনেক কষ্ট করে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করেও জীবিকা নির্বাহ করার জন্য তার ভাগ্যে জোটেনি একটি ছোট খাট চাকুরী। যথেষ্ট আত্মসম্মান বোধ থাকা সত্ত্বেও কোন চাকুরী না জোটাতে পারার কারণে কেতু অবশেষে ভিক্ষা করে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করে। শুধু একজন কেতু নয়, দলিত সমাজে এ রকম কেতু আরও রয়েছেন যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শোষণের শিকার।

গত ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল যে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, সরকারি, স্বায়ত্ত¡ শাসিত প্রতিষ্ঠানে ক্লিনার, সুইপার পদে দলিত পেশাজীবী পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জন্য ৮০ ভাগ কোটা সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছিল। এছাড়া যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু সরকারি ও স্বায়ত্ত¡ শাসিত প্রতিষ্ঠানে এ নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছেনা।

দলিতদের শিক্ষা ও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরি দিতে হবে, সরকারি ও বেসরকারি যেকোনো চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে দলিতদের প্রতি জাত–পাত ভিত্তিক বৈষম্য বন্ধ করতে হবে। দলিতদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। বিকল্প পেশায় সক্ষমতা ও সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি আধা সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পেশায় অগ্রাধিকার দিতে হবে।

হরিজনদের হোটেল রেষ্টুরেন্ট এ প্রবেশে বাঁধা দেওয়া হয়। তাদের খাবার দেওয়া হয় খবরের কাগজে বা পলিথিনে মুড়ে। রেল লাইন, রাস্তা, ময়লা আবর্জনার পাশে বসে খাবার খেতে অথবা হরিজনদের নিজস্ব আলাদা কাপ, গ্লাস ও প্লেট নিয়ে হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে খাবার গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। এর প্রতিবাদ করলে হোটেল মালিক শ্রমিক দ্বারা চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

সংবিধানের আলোকে দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি দলিত জনগোষ্ঠীর সমঅধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দলিত জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এরপরও তারা মূলধারার জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত হতে পারেনি, কিন্তু আমাদের সংবিধানের মূলসুরকে ধারণ করে দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা জরুরী।

আমাদের দেশে যে দলিত জনগোষ্ঠীর বাস, এদেও সঠিক সংখ্যা এখনো নিরূপণ করা হয়নি। এদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। কারও মতে এদের সংখ্যা ৩৫ লাখ থেকে ৫৫ লাখ। আবার কারও হিসাবে এদেও সংখ্যা ১৫ লাখের মতো। এরা সমাজে অত্যন্ত অবহেলিত এবং নানাদিক থেকে সুবিধা বঞ্চিত।

বাংলাদেশে দলিতদের এ বিরাট সংখ্যক নাগরিক অনেক রকম ন্যায্য সুযোগের অভাবে আর দশ জনের থেকে পিছিয়ে রয়েছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান ইত্যাদি থেকে যেমন তারা পিছিয়ে আছেন, তেমনি পিছিয়ে আছেন মৌলিক মানবাধিকার থেকেও। সমাজে প্রচলিত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ, ভূমির অধিকার প্রাপ্তি এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সেবাগুলো থেকেও তারা বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। এমনকি এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তাদের অত্যন্ত অমার্যাদাকর আচরণের মুখোমুখি করা হয়।

এই যে বঞ্চনা, পিছিয়ে রাখার মনোবৃত্তি তা জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রগতির গতিধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমরা যখন সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এবং কাউকে পিছিয়ে রেখে নয়- এমন উন্নয়নের কথা বলছি তখন এ মানুষগুলোর কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ টেকসই উন্নয়নের নিশ্চিত করতে হলে তাদের অধিকার শতভাগ নিশ্চিত করার বিষয়টিকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মানতে হবে।

আগামী ২০৩০ এর মধ্যে যে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট নির্ধারণ কওে আমরা এগোচ্ছি তার অন্তত আটটি অভীষ্ট (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৮, ১০, ১৬) অর্জন করা সম্ভব নয়যদি না আমরা দলিতদের মর্যাদাপূর্ণ উন্নয়নকে চিন্তায় রাখি। সংবিধানের ২৩ (ক) ধারায় দেশের জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’ অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধানের যে অঙ্গীকার- ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থান নির্বিশেষে সব মানুষ সমান তার মূলসুরকে ধারণ কওে যদি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হয় তাহলে প্রয়োজন এক নবতর উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি। আর তার সূচনা হতে পারে দলিতদের মতো সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নাগরিকদের জন্য বিশেষ উন্নয়ন ও নীতি পরিকাঠামো তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়ে।

সেরকম একটি উন্নয়ন দর্শন এবং অন্তর্ভুক্তি মূলক উন্নয়ন ধারণা গ্রহণের দাবি নিয়ে দলিত নাগরিকদের জন্য সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কিছু দাবি ও সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশা প্রস্তাব করা যেতে পারে।

প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের নির্বাচনী ইশতেহারে দলিত জনগোষ্ঠীর অধিকার, মর্যাদা ও যথাযথ উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকতে হবে। দলিত সম্প্রদায়ের সব মানুষ যে যেখানে আছেন সেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়তাদের জন্য স্থায়ী আবাসের ব্যবস্থা করা এবং মালিকানা তাদের বুঝিয়ে দেওয়া। দলিত নাগরিক যারা নানাকারণে পিছিয়ে রয়েছেন, তাদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সব ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা সংরক্ষণ করতে হবে।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম এবং অন্যান্য মৌলিক সেবাসমূহে দলিত নাগরিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা যাতে কওে তারা কোনো বাধা ছাড়াই তাদের ন্যায্য পাওনা পেতে পারেন। দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষায় অগ্রাধিকার ভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে কওে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয়।

বাজেটে দলিত নাগরিকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রেখে সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকর উদ্যোগ ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। অনতিবিলম্বে বর্ণ-বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, অনুমোদন ও তার বাস্তবায়ন করা জরুরী। একটি কার্যকর জাতীয় জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে দলিতদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত নেতিবাচক প্রভাব থেকে উত্তরণ, টেকসই অভিযোজন সক্ষমতা তৈরি এবং আর্থিক সেবাসমূহে দলিতদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতকরণে বিশেষ উন্নয়ন পরিকল্পনাগ্রহণ এবং এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নীতি-কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে।

দলিতদের জন্য একটি সময় নির্দিষ্ট জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দলিত মানুষ সম্পর্কে বিদ্যমান ভুল ধারণা, ভুল উপস্থাপন এবং নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন, বেতার এবং বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল সমূহে ইতিবাচক অনুষ্ঠান প্রচার করা।
মোঃ খলিলুর রহমান, তৃণমূল সংবাদকর্মী, ঝিনাইদহ এবং বাংলাদেশ দলিত এন্ড মাইনরিটি হিউম্যান রাইটস্ মিডিয়া ডিফেন্ডার ফোরামের সদস্য।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button