ঝিনাইদহের সাব্বিরের বাংলাদেশ জয়

ঝিনাইদহের চোখঃ
ঝিনাইদহের ছেলে সাব্বির। সড়কপথে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে ঝিনাইদহের দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। বাস ভাড়া ৭০০ টাকার কাছাকাছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে লম্বা ছুটি পড়লে সাইকেলে চড়েই বাড়ি যেতেন সাব্বির। ছুটি শেষে ক্যাম্পাসে ফিরতেনও একইভাবে। লোকজন ভাবত শখের বসে পাগলামি করছেন; কিন্তু না। বাস ভাড়া বাঁচানোর জন্যই সাব্বিরের এত আয়োজন।
নুন আনতে পান্তা ফুরাত সাব্বিরদের। বাবা সাইকেলের মেকানিক। মা গৃহিণী। তিনি প্রতি মাসে গরুর ঘুটা (গোবর দিয়ে তৈরি জ্বালানি) বিক্রি করে ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন। বাবা অন্যের সাইকেল ঠিক করতেন। সেই কাজে বাবাকে সাহায্য করতেন সাব্বির। সাইকেলের প্রতি ভালোবাসাও সেখান থেকেই। সাইকেল কেনার বায়না ধরেছেন অনেকবার। কিন্তু তখন অর্থের অভাবে ছেলের শখ মেটাতে পারেননি সাব্বিরের মা-বাবা।
অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন সাব্বিরের বড় ভাই সাগর হোসেন। সেই বৃত্তির টাকা দিয়ে একটি পুরনো সাইকেল কিনলে তার হাত ধরেই সাইকেল শেখেন সাব্বির। এরপর বড় ভাই বাড়িতে না থাকলেই বেরিয়ে পড়তেন সাইকেল নিয়ে। কখনো কখনো ১০-১৫ কিলোমিটার দূরেও চলে যেতেন। স্কুলের বইয়ে ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনি পড়ে অভিভূত হয়েছেন। একসময় স্বপ্ন দেখতে থাকেন—সাইকেলে বাংলাদেশ ভ্রমণ করবেন।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মত্স্য বিজ্ঞানে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে সাব্বিরের স্বপ্নের পালে নতুন করে হাওয়া লাগে। যোগাযোগ করার জন্য একটা মোবাইল কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও ছিল না তাঁর পরিবারের। অবশ্য মোবাইলের প্রতিও সাব্বিরের তেমন ঝোঁক ছিল না। টার্গেটই ছিল ভালো ব্র্যান্ডের একটা সাইকেল কিনবেন। অনার্সের দ্বিতীয় বর্ষে এসে সাব্বিরের স্বপ্ন সত্যি হতে শুরু করে।
বড় ও ছোট বোন ১০ হাজার টাকা, ছোট ভাইয়ের ৫০০ টাকা এবং নিজের কিছু জমানো টাকায় কিনে ফেলেন নতুন একটি সাইকেল।
এরপর হার না-মানা ওই তরুণ একে একে ঘুরে বেরিয়েছেন বাংলাদেশের সব জেলা। ২০১৭ সাল। প্রথম জেলা হিসেবে নেত্রকোনা দিয়ে দেশ ভ্রমণ শুরু করেন সাব্বির। কিছুদিন আগে ৬৪তম জেলা হিসেবে কক্সবাজারে গিয়ে শেষ হয় তাঁর বাংলাদেশ ভ্রমণ।
দীর্ঘ এই পথচলায় মুখোমুখি হতে হয়েছে অনেক সমস্যার, বিশেষ করে অর্থের। বিভিন্ন জেলায় গিয়ে টাকার অভাবে হোটেলে উঠতে পারেননি। চায়ের দোকানে, খাবার হোটেলে রাত কাটিয়েছেন। কখনো কখনো একবেলা খেয়েই দিন পার করেছেন। কিন্তু নিজের লক্ষ্য থেকে টলেননি।
ক্যাম্পাসে লম্বা ছুটি পড়লে সহপাঠীরা কেউ বাড়ি চলে যেত, কেউ হয়তো দলবেঁধে ঘুরতে বের হতো। ছুটির আগেই সাব্বির ঠিক করে রাখতেন কোন জেলায় যাবেন। কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করলে ফজরের আজানের ঠিক পর পরই বেরিয়ে পড়তেন। সব সময় সঙ্গে নিতেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। সঙ্গে থাকত পানির বোতল, হেলমেট, ব্যাগের ভেতর টি-শার্ট, ব্রাশ, ফোনের চার্জার প্রভৃতি। দিনে তো বটেই, কখনো কখনো রাতেও সাইকেল চালিয়েছেন। বললেন, ‘অনেক জেলায় গিয়ে বন্ধুদের বাসায়ও থেকেছি। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের বড় ভাই, যাঁরা এখন বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত, তাঁরাও আমাকে ভীষণ সহযোগিতা করেছেন। বেশির ভাগ সময়ই অপরিচিত মানুষের বাসায় থাকতাম। কোনো কোনো রাতে মসজিদেও থেকেছি। যখন থাকার ব্যবস্থা করতে পারতাম না, তখন রাতেও সাইকেল চালিয়েছি। নতুন কোনো জায়গায় গিয়ে চেষ্টা করেছি মানুষকে বুঝিয়ে রাতটা কাটানোর। আসলে অপরিচিত মানুষদের আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করত। বিভিন্ন জেলায় স্কুল-মাদরাসার বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি, ছবি তুলেছি। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।’
অবশ্য একবার পিরোজপুরে গিয়ে বিপদে পড়ছিলেন সাব্বির। বাসটার্মিনালের পাশে একটি চায়ের দোকানে ঘুমাচ্ছিলেন। কিছু নেশাখোর তাঁর টাকা-পয়সা-সাইকেল ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। ওদের দ্বারা শারীরিক লাঞ্ছনারও শিকার হন তিনি।
এই তরুণ যেখানেই গেছেন সেখানে মানুষের সঙ্গে সমাজের অসংগতি নিয়ে কথা বলেছেন। সাইকেলের সামনে কিংবা বুকে করে বহন করেছেন সচেতনতামূলক প্লাকার্ড। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘চলো যাই যুদ্ধে-মাদকের বিরুদ্ধে’, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘কোটা সংস্কার করুন’, ‘রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার চাই’, ‘রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নাও’ ‘ধর্ষণকে না বলুন’, ‘পরিবেশ দূষণ রোধ করি’, ‘গাছ লাগান’, ‘বাল্য বিবাহকে না বলুন’ ইত্যাদি। সাব্বির বললেন, আমরা যাঁরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, আমাদের প্রত্যেকের জন্য সরকারের অনেক টাকা ব্যয় হয়। এ অর্থ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে সবার ভ্যাট ট্যাক্সের। তাঁদের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আছে।
এই দীর্ঘ ভ্রমণে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি। দেখা করেছেন ভাষাশহীদ আব্দুল জব্বারের পরিবার, এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহীম, বাংলাদেশ ওয়ান ডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ হওয়ার পর অনেকেই সাব্বিরকে ঝিনাইদহ এক্সপ্রেস বলে ডাকতে শুরু করে।
সাব্বির এখন মাস্টার্সের ছাত্র। ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘এবার জগত্টাকে দেখার পালা। শুরুতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথম দেশ ভুটানে যেতে চাই। সেখানে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও ভুটানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমার সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নাই। তাই কারো সহযোগিতা পেলে ভালো হতো।’