কালীগঞ্জ

কালীগঞ্জের পাখা পল্লীতে এক দশকের সেরা বিক্রি

ঝিনাইদহের চোখঃ

সারা দেশে প্রচ- তাপপ্রবাহে প্রাণীকুল হাঁফিয়ে উঠেছে। পহেলা বৈশাখের দিন থেকে এ পর্যন্ত কয়েক দিন ছিটেফোঁটা বৃষ্টির দেখা মিলেছে। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই সূর্য ভয়ঙ্কর অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে। সঙ্গে ভ্যাপসা গরমে জনজীবনে নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে লোডশেডিংও পাল্লা দিচ্ছে। ফলে গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে মানুষের এখন ভরসা হাতপাখা। এ কারণে বর্তমানে তালপাখার চাহিদার সঙ্গে বিক্রি ও দাম উভয়ই বেড়েছে। পাখাপল্লীর কারিগররা দিন-রাত ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রচ- গরমে কাজের চাপে কারিগরদের শরীর ঘেমে গেলেও নিজের তৈরি পাখার বাতাস নেওয়ার সময় তাদের নেই। এমন অবস্থা বিরাজ করছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার পাখা পল্লীখ্যাত পারিয়াট গ্রামে।

বুধবার সকালে সরেজমিন উপজেলার পারিয়াট গ্রামের পাখা পল্লীতে গেলে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই ছায়াযুক্ত জায়গায় পরিবারের সদস্যরা গোল হয়ে বসে কেউ পাতা কেটে সাইজ করছেন, কেউ নিপুণভাবে সেলাই করছেন, কেউ সুতা ও বাঁশের শলায় রং লাগিয়ে নকশা করছেন। কেউ তৈরি করা পাখা বাজারজাত করতে বোঝা বাঁধছেন। আবার কেউ পাইকারি ক্রেতাদের সঙ্গে বকেয়া হিসাব ও আপ্যায়নে ব্যস্ত। এমন অবস্থায় কথা বললে তাদের উত্তরটা ভিন্ন, যা বলবেন তাড়াতাড়ি বলেন ভাই, কাজের চাপে বসে গল্প করার সময় নেই।

তালপাখার কারিগর বয়োবৃদ্ধ মোজাহার বিশ্বাস জানান, তাদের পূর্বপুরুষরা পাখা তৈরির কাজ করতেন। তাদের পেশাটাকে ধরে রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি জানান, তাদের গ্রামের প্রায় অর্ধশত পরিবার তাল পাখা তৈরির পেশায় রয়েছেন। তাদের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকে বড়দের কাজে সাহায্য করতে করতে তারাও নানা নকশার পাখা তৈরিতে পারদর্শী হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, তার পাঁচটা ছেলে। সবাই পৃথক সংসারে পাখা তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত।

কারিগর আব্বাস আলী জানান, বছরের চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ এ তিন মাসকে পাখা বিক্রির মৌসুম ধরা হয়। আবহাওয়া ঠা-া হলে অথবা শীত এলে বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ৩ মাসের রোজগারের পয়সায় তাদের সারা বছর চলতে হয়। তিনি জানান, এ এলাকায় এখন আর তাল পাতা পাওয়া যায় না। শীত মৌসুমে পাখা তৈরির প্রধান উপকরণ তাল পাতা ফরিদপুর ও নড়াইল জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা চারা তালগাছের পাতা কিনে বাড়িতে এনে রোদে শুকিয়ে পাতা রাখার ঘরে মজুদ করে রেখে দেন। এরপর প্রয়োজন মতো পাতা রাখার ঘর থেকে বের করে পানিতে ভিজিয়ে রেখে পাতা নরম হলে তা গোলাকার সমান ভাগে কেটে ফেলেন। তিনি জানান, একটি পাতা থেকে দুটি পাখা তৈরি করা যায়। তিনি আরও জানান, এ এলাকায় পাতা না পাওয়ার কারণে অন্য জেলা থেকে পাতা আনতে পরিবহন খরচ বেশি পড়ে যায়।

কারিগর আজিজুল বিশ্বাস জানান, এ বছর গ্রীষ্মের শুরু থেকে দিনের বেলা প্রচ- তাপপ্রবাহ আর রাতের ভ্যাপসা গরমে পাখার ব্যাপক চাহিদা। গ্রামের সব বাড়িতেই পাখা তৈরি করা হয় ফলে গ্রামটি তালপাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে আশপাশের অনেক জেলার পাইকাররা এসে এ পাখা পল্লী থেকে নগদ টাকায় কিনে নিয়ে যান। তিনি বলেন, গরম ছাড়া বছরের অন্য সময় তালপাখা তৈরির কাজ চললেও বিক্রি বন্ধ। তাই তারা শীতের আগমনকে ভয় পান। এ বছর প্রতিটি পাখায় তৈরি পর্যন্ত খরচ হচ্ছে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকা। আর পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকা। আগে থেকে কাঠামো তৈরি করা থাকলে একজন কারিগর প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০টি তালপাখা তৈরি করতে পারেন। ফলে প্রতিটি কারিগর বিক্রির মৌসুমে দিনে যাবতীয় খরচ বাদে প্রায় সাড়ে ৪০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা রোজগার করতে পারেন। এ সময় কারিগরদের একটি ছোট পরিবারেও সব খরচ বাদে প্রতিদিন কমপক্ষে ১ হাজার টাকা রোজগার হয়ে থাকে। আর বড় পরিবারের রোজগার হয় আরও বেশি।

বুলু মিয়া নামে এক কারিগর জানান, এ বছর গরমের কারণে পাখার চাহিদা ও দাম অপেক্ষাকৃত বেশি। চলতি বছরে প্রায় ৬ লক্ষাধিক টাকার পাখা বাড়ি থেকেই পাইকারি বিক্রি করেছেন। চাহিদা বেশি হওয়ায় তাদের অনেক কারিগর পরিবারের তালপাতা ফুরিয়ে গেছে। ফলে পাতার অভাবে অনেক পরিবার এরই মধ্যে পাখা তৈরির কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। এ বছর যে পরিমাণ পাখা বিক্রি করেছেন তা বিগত এক দশকের সেরা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তাদের এ পেশাটাকে ধরে রাখতে হলে অর্থের প্রয়োজন। আগে অনেকবার স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার জন্য আবেদন করেও তা পাননি। অথচ অন্য পেশার মানুষদের জন্য এ সুযোগ রয়েছে।

অমেলা বেগম নামে এক বৃদ্ধা কারিগর জানান, আজ থেকে প্রায় ৫৫ বছর আগে এ গ্রামে বউ হয়ে আসি। তখন শ্বশুরের পরিবারের সবাই পাখা তৈরির কাজ করতেন। ফলে কালক্রমে তিনিও পাখা তৈরির কাজ শিখে প্রায় ৫০ বছর পার করছেন। পাখার কাজ করা স্থানীয় তালিয়ান মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী বর্ষা খাতুন জানায়, লেখাপড়ার পাশাপাশি সে পরিবারের বড়দের পাখা তৈরির কাজে সাধ্যমতো সাহায্য করে থাকে। সে জানায়, গরমের দুই মাস পাখা কাটতির সময় বাড়ির কেউ বসে থাকে না।

কোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ূব হোসেন জানান, পারিয়াট পাখা পল্লীর কারিগররা সবাই গরিব। তারা বছরের মাত্র ৩ মাস পাখা বিক্রির সুযোগ পান। বাকি সময়টা তাদের অভাবে দিন কাটে। ফলে তারা স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার যোগ্য। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা এ এলাকার পাখা গরমের সময় পাইকাররা কিনে বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যাচ্ছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button