ঝিনাইদহে তালের শাসের চাহিদা বেড়েছে
মনজুর আলম, ঝিনাইদহের চোখঃ
‘আহারে আহারে, খাইতে কি মজারে, পাওয়া যায় বাজারে, তার নাম আশাড়ি।’ আশাড়ি মানে তালের শাস। এমনি করে তালের শাস খাচ্ছিল আর কথাগুলো বলছিল ছোট্ট মাহির। গরমে ভারি আরামদায়ক, রসালো ও সুমিষ্ট এই ফলটি। রমজানের ইফতারেও মজাদার। বলদায়ক ও পুষ্টিকারক এ তালের শাসের চাহিদা বেড়েছে।
বাংলাদেশে তালের ব্যাপক চাষ হলেও ফলটির আদি নিবাস আফ্রিকা। কেউ কেউ বলেন এর জন্মস্থান আমাদের উপমহাদেশেই। তবে এর জন্ম যেখানেই হোক, ফলটি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে এটাই সত্য। বারো মাস গাছে তাল ফললেও কচি তালের শাঁস ঠিক এই সময়টিতেই বাজারে পাওয়া যায়। কেউ বলে তালের শাস, কেউ বলে তালের আশাড়ি, কেউ বলে তালের আঁটি। গরমের মধ্যে তৈলাক্ত খাবারের চেয়ে তালের শাস অনেক উপকারী। এর রয়েছে অনেক গুনাগুন। তাই জৈষ্ঠের এ মধু মাসে বাজারে নানা ফল ওঠলেও রূপগঞ্জে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে তালের শাস। গ্রীস্মের এই দিনে ঝিনাইদহে তালের শাঁস খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। তাই সবার হাতে পোঁছে যায় কঁচি তালের শাস। বর্তমানে এর চাহিদা অনেক বেড়েছে।
জানা গেছে, ঝিনাইদহের গৃহস্তদের গাছের তালের শাস যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীসহ সকল বয়সী লোকজনের কাছে তালের শাসের কদর দিন দিন বেড়েই চলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রচণ্ড গরমে তালের কচি শাঁস এবং এর ভেতরের মিষ্টি পানি তৃষ্ণা মিটিয়ে শরীরে এনে দেয় আরামদায়ক অনুভূতি। তালের আশে প্রতি ১০০ গ্রামে ০.৮ গ্রাম খাদ্যপযোগী খনিজ পদার্থ, ২০.৭ গ্রাম শর্করা, ০.৮ গ্রাম আমিষ, ০.৫ গ্রাম আঁশ রয়েছে। গরমে শরীরের পানির অভাব পূরণ করতে এর মধ্যে আছে ৭৭.৫ ভাগ জলীয় অংশ। ০.৫ গ্রাম খাদ্য আঁশ থাকায় এটি হজমে সহায়ক। অবাক করার মতো খাদ্যশক্তি রয়েছে তালের শাঁসে। প্রায় ৮৭ কিলো ক্যালোরি। ৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকায় তালের শাঁস হাড় গঠনেও দারুণ ভূমিকা রাখে।
ঝিনাইদহ জেলার উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তালগাছ রয়েছে। তবে কৃষি বিভাগে এর কোন পরিসংখ্যান নেই। তালের শাস অতি সুস্বাদু হওয়ায় সকল শ্রেণির মানুষের কাছে তালের শাস একটি জনপ্রিয় ফল। এখন উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার ও বাসস্ট্যান্ডগুলোতে এবং অলিতে গলিতে তালের শাস বিক্রি করে অনেক হত দরিদ্র মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন।
কোটচাঁদপুর পোষ্ট অফিস এলাকার আলম মিয়া জানান, তিনি প্রতিবছরই এ দিনে তালের শাস বিক্রি করে সংসার চালান। গ্রাম অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে তাল ক্রয় করে গাছ থেকে পেরে এনে শাস বিক্রি করেন। তবে গাছ ওঠে তালের শাস পারা সবচেয়ে কষ্টকর। বৈশাখ মাস থেকে জৈষ্ঠের অর্ধেক পর্যন্ত এ দেড় মাস চলবে তালের শাস বিক্রির কাজ। প্রতিদিন প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ শাস বিক্রি করা যায়। একটি শাস আকার ভেদে ৪ থেকে ৫টাকা দরে বিক্রি করছেন। এতে তার বেশ টাকা লাভ হয়। তালের শাস বিক্রি করে সংসার ভালই চলছে।
তালের শাসের ক্রেতা সামসু উদ্দিন জানান, তালের শাস একটি সুস্বাদু ফল। গরম থেকে এসে তালের শাস খেতে ভালই লাগে। ফলে এর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। তবে ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে’ কবিগুরুর সেই কবিতার মতো সারি সারি তালগাছ রাস্তার দুধারে এখন আর চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আবাসন গড়ার ধাক্কায় ঝিনাইদহের গ্রাম এলাকার তালগাছ হারিয়ে যাচ্ছে।
মহেশপুরের বেলেমাঠ এলাকার কৃষক রমজান মিয়া জানান, এক সময় মানুষ শখ করে বাড়ির পাশে কিংবা রাস্তার ধারে তালের বীচ বপন করতো। গাছ থেকে তাল পারা খুব কষ্টকর হওয়ায় মাঝখানে তালগাছ বপন আরো কমে গিয়েছিল। এলাকা ভেদে একটি তালের পাইকারি দাম তিন থেকে চার টাকা বিক্রি হচ্ছে।
কোটচাঁদপুরের পাইকারী তাল শাস বিক্রেতা মোজাম্মেল হক জানান, ‘আমরা একটি গাছের তাল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কিনে থাকি। ঢাকায় নিয়ে এক হাজার তাল শাস ২ থেকে ৩হাজার টাকায় বিক্রি করি।’ তিনি আরো জানান, এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত তাল শাস বিক্রি করা যাবে।
তালের শাসের পুষ্টি গুনাগুণ সম্পর্কে ডা. মেহেদী হাসান বলেন, তালের শাস শরীরের জন্য খুবই উপকারী একটি ফল। গরমের দিনে তালের শাসে থাকা জলীয় অংশ পানি শূন্যতা দুর করে। এছাড়া ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, এ, বিকমপ্লেক্সসহ নানা ধরনের ভিটামিন রয়েছে। তালে থাকা এন্টি অক্সিডেন্ট শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। কচি তালের শাস রক্তশূন্যতা দুর করে। চোখের দৃষ্টি শক্তি ও মুখের রুচি বাড়ায়।