প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এ পাখি
#ঝিনাইদহের চোখঃ
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই, আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোধ, বৃষ্টির, ঝড়ে। বাবুই হাসিয়া কহে, সন্দেহ কি তাই? কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়। পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।
কবি রজনীকান্ত সেনের এই কবিতাটি পড়িয়ে ছোটবেলায় আমাদের শিক্ষকরা সততা আর নৈতিকতা শিক্ষা দিতেন। নিজে লড়াই করে স্বাধীনভাবে বাঁচার শিক্ষা দিতেন। নিজের কাজকে ভালোবাসা ও সম্মানের শিক্ষার উদাহরণ হিসেবে বাবুই পাখি আমাদের খুব প্রিয়।
একটা সময় আশপাশে প্রচুর তাল গাছ ছিল। আর সেই গাছে প্রকৃতির নিপুণ শিল্পী বাবুই বাসা বাঁধতো পরম যত্নে। ধৈর্য নিয়ে আপন মনে বুনতো নিজ বাসা। তবে এই পাখিকে আমরা শুধু পরিশ্রমী আর সততার প্রতীক হিসেবেই চিনি। কিন্তু তাদের শিল্পগুণের পেছনে রয়েছে আরেক কাহিনী। আর সেটি তার প্রেমিকাকে খুশি করার অদম্য বাসনা।
বাবুই পাখির যখন প্রজনন মৌসুম আসে তখন পুরুষ বাবুইটি একের পর এক বাসা গড়তে থাকে তার প্রেমিকাকে খুশি করতে। একেকটি পুরুষ বাবুই এক থেকে ২০টি পর্যন্ত বাসা তৈরি করে। বাসা তৈরির কাজ শেষ হলে সুরে সুরে তার প্রেমিকাকে আহ্বান জানায়। তার ডাকে কাছে আসে স্ত্রী বাবুই পাখি। এসেই পরখ করে দেখে কেমন হলো তার বাসা। যদি সে বাসা পছন্দ হয় এবং নিরাপদ মনে করে তবেই সে মিলিত হয় পুরুষ বাবুইর সঙ্গে। তাদের বাসায় ডিম আসে বাচ্চা ফোটে। একই সঙ্গে একটি পুরুষ বাবুই একাধিক সংসার গড়ে তাই এতো বাসা তৈরি করে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য এম এ তাহের জানান, বাবুই পাখি সাধারণত তিন ধরনের বাসা তৈরি করে। নিচের দিকে অনেক লম্বা সরু একটা রাস্তা থাকে, যে রাস্তা দিয়ে বাসার ভেতরে ঢোকে। এমন বাসা অনাগত ছানার জন্য নিরাপদ। আরেক ধরনের বাসার বেশিরভাগ অংশ খোলা থাক। এমন বাসা বানানোর পেছনের কারণ হচ্ছে, বাবুই পাখিটি এই বাসায় বিশ্রাম করে বা এখানে বসে আশেপাশে সতর্ক পাহারা বসায়। আরেকটি বিশেষ ধরনের বাসা বানায়, যার ভেতরে দুইটি অংশ থাকে। সে বাসায় সংসার ছানাসহ বিশ্রামের আলাদা জায়গা থাকে।
কিন্তু চিরচেনা সেই দৃশ্যের দেখা এখন আর তেমন মেলে না। কারণ উঁচু তাল, নারিকেল ও সুপারি গাছ কমে যাওয়ায় বাসা বুনার উপযুক্ত স্থান হারাচ্ছে ক্রমশ। অতি লোভে দামি গাছ লাগানোর জন্য গাছপালা কেটে ফেলছে। ফলে বিপদে পড়ছে বাবুই পাখিরা।
বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখির প্রথম পছন্দ তাল গাছ। এরপর নারিকেল বা সুপারি গাছ। এই সব গাছের পাতার সাথে অন্য লতাপাতা মিশিয়ে তারা বাসা গড়ে। উপরে বাসা বানানোর কারণে সে নিরাপদে থাকতে পারে। তাল গাছ বা নারিকেল গাছের এতো উপরে থাকে সেখানে সাধারণ অন্য কোনো কিছুর নাগালের বাইরে থাকে।
সেই বাবুই পাখি ২০/২৫ বছরের ব্যবধানে চরম সংকটে পড়েছে। এতোটাই সংকটে যে বাধ্য হয়ে কলা গাছ বা বিভিন্ন ঝোপে বাসা বানাচ্ছে। বাবুই পাখি প্রজননের এই সময়টায় আরও বেশি বিপদে পড়েছে। কলা গাছের মতো নিচু গাছে ঝুকি আছে জেনেও বাসা তৈরি করছে তারা। যেই বাসা থেকে বাচ্চারা ঢিল মেরে তাদের ডিম নষ্ট করে দিচ্ছে, তবুও এই নিচু জায়গা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মানুষের হিংস্র থাবার কাছে হার মেনেছে বাবুই পাখির জীবনের মায়া। এমন কিছু বাসার ছবি কেরানিগঞ্জে কয়েকটি এলাকায় দেখতে পান বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য এম এ তাহের।
তিনি জানান, অতি লোভে আমরা তাল গাছ কেটে অন্য গাছ লাগাচ্ছি। তার ওপর কিছু কুসংস্কার আছে। গ্রামের মানুষ মনে করে তাল গাছে ভূতে বাসা বাধে। আর সে ধারণা থেকেই বেশিরভাগ তাল গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। জ্ঞানের অভাবে টাকার লোভে প্রকৃতি ধ্বংস করে চলেছি উন্নয়নের প্রতিযোগী হয়ে। তাদের এই অবস্থা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কী করছি আমরা তাদের সাথে! নির্লজ্জের মতো মাথা নিচু করে রইলাম। এতটা পাষাণ আমরা কী করে হলাম? একটি গাছ কেটে কয়টি গাছ লাগিয়েছি আমরা তা কি ভেবে দেখেছি কখনো? আমি প্রথম দেখলাম কলা গাছের ডালে এবং কাশবনে বাসা বানাতে আর কেউ দেখেছে কি না, আমার জানা নাই। কতোটা বিপন্নর কাতারে চলে যাচ্ছে বাবুইপাখি। প্রকৃতি না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে কীভাবে?
এ বিষয়ে পাখিবিদ এস আই সোহেল বলেন, এই পাখির বাংলা নাম : দেশি-বাবুই, ইংরেজি নাম : Baya Weaver, বৈজ্ঞানিক নাম Ploceus philippinus। সাধারণত মে থেকে আগস্টের মধ্যে বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। একটি পুরুষ পাখির একাধিক বাসা ও পরিবার থাকতে পারে। এরা সাধারণত ২ থেকে ৪টি ডিম দেয়। ডিম ফুটে ছানা বের হতে ১৪ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। মেয়ে পাখি একা ডিমে তা দেয়। একটি ছানা ১৪ থেকে ১৬ দিনে নিজের মতো চলার সক্ষমতা অর্জন করে। বাবুই পাখিদের খাদ্য তালিকায় আছে ঘাস-বীজ, খাদ্যশস্য ও পোকা-মাকড়।
তিনি আরও জানান, বাবুই পাখি তাল, নারকেল, সুপারি, খেজুর ও বাবলা গাছে বাসা করে থাকে। তবে বাসা বাধার জন্য সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে তাল গাছ। কিন্তু প্রকৃতি উজাড় করে তাল গাছ কেটে তাদের আবাসন আমরা ইতোমধ্যে নষ্ট করে ফেলেছি।