মাংসের জন্য গরু-ছাগল উৎপাদনে ঝিনাইদহ অগ্রগামী : ভারত-মিয়ানমারের ওপর নির্ভরশীল নয়
#ঝিনাইদহের চোখঃ
বাংলাদেশ এখন গবাদিপশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সামনে চ্যালেঞ্জ জনগণের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করা। গত ১০ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেড়েছে এই খাতের ভূমিকা। বাংলাদেশ আজ ডিম, মাংস ও দুধ উৎপাদনে চাহিদার প্রায় কাছাকছি পৌঁছে গেছে। ভারত থেকে আসা গরুর ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাংলাদেশের খামারিরা পশু পালনে উৎসাহী হয়ে গত দশ বছরে মাংসের উৎপাদন বেড়েছে। দেশ মাংস উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। আজ থেকে চার বছর আগে ভারত থেকে অবৈধ পথে গরু আসা প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সেই মাংসের চাহিদা মেটাতেই বাংলাদেশে গড়ে ওঠে অসংখ্য খামার। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহায়তায় নানামুখী প্রকল্পে চার বছরেই বদলে গেছে চিত্র। এখন ভারত মিয়ানমারের গবাদিপশুর ওপর নির্ভরশীলতা একেবারেই নেই। সরকারের ভিশন-২০২১ অনুযায়ী প্রতিদিন জনপ্রতি দুধ ১৫০ মিলি লিটার ও মাংস ১১০ গ্রাম চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রতিদিন ৯৪ লাখ ৬০ হাজার টন দুধ ও ৬৯ লাখ ৬০ হাজার টন মাংস এবং বছরে ১৭ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজারটি ডিম উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে সরকারের আশা।
গবাদিপশু ও মাংসের উৎপাদন বাড়ছে : গত নয় বছরে মাংসের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে সাত গুণ। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ বছরে মাংসের উৎপাদন ছিল ৭.১৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ২০০৮-৯ অর্থবছরের তুলনায় এটি ৬.০৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন বেশি। ওই বছর উৎপাদন ছিল ১.০৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের বার্ষিক চাহিদা পূরণের পর ১৯ হাজার মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত মাংসও ছিল। ফলে, গত তিন বছরে মাংসের চাহিদা মেটাতে জন্য গবাদিপশু আমদানির প্রয়োজন পরেনি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গবাদিপশুর মোট পরিমাণ (গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া) ৫ কোটি ৫১ লাখ ৪০ হাজার, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল গবাদিপশুর সংখ্যা পাঁচ কোটি ৪৭ লক্ষ ৪৫ হাজার। আর ২০০৮-৯ অর্থবছরে ছিল ৪ কোটি ৯৫ লক্ষ ৫৮ হাজার। গত ১০ বছরে ৫৬ লাখেরও বেশি গবাদিপশু উৎপাদন হয়েছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশন বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নিবন্ধিত খামারির সংখ্যা বেড়েছে ১০ হাজার। আর নিবন্ধনের বাইরে আছে আরো ১০ হাজার। ফলে এখন ভারত থেকে অবাধ পথে আসা গরু বন্ধ করতে হবে। অবৈধ পথে গরু এলেই খামারিরা লোকসানের মুখে পড়বে। কারণ, এতে তাদের পশুর দাম পড়ে যাবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিশেষ প্রকল্প : প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এমনই একটি আদর্শ কার্যক্রম, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে খুলনা বিভাগের ১০ জেলার এমডিজির পর এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাম্প্রতিক সময়ে প্রাণিসম্পদ খাতের কার্যক্রম আরো বেগবান করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে কারিগরি ও সেবা সহায়তা। যে খামারিরা গবাদিপশু উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে তাদের সুরক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলে তাদের আয় বৃদ্ধি পরিকল্পনা করা হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও নড়াইল জেলার ৬০টি উপজেলায় ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি গ্রামে কৃষক পর্যয়ে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত গবাদিপশু লালন পালনে। শেখানো হচ্ছে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিসহ সংরক্ষণ, গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ’সহ নানা কৌশল। খামারিদের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, যন্ত্রপাতি প্রদান, রোগবালাই প্রতিরোধে টিকা প্রদান ও ব্যবসা সম্প্রসারনে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। দেখা গেছে, এতে গবাদিপশুর সংখ্যা বৃদ্ধি ও ডিম দুধ উৎপাদন যেমন বেড়েছে তেমনি খামারিদের আয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
সচ্ছলতা আনছে মানুষের জীবনে : ছাগল পালনে ছেলেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন ঝিনাইদহের কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের ধোপাবালিয়া গ্রামের বিল্লাল হোসেন। বললেন, ‘মাশাল্লা খেয়েপরে ভালো আছি ভাই। আগে অনেক অভাব ছিল। কিন্তু ছাগল লালনপালন করে সেই অভাব দূর হয়েছে।’ বিল্লালের এখন ৬০টিরও বেশি উন্নত জাতের ব্লুাক বেঙ্গল গোট আছে। যশোরের চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের চুমানকাটি গ্রামের পবিত্র কুমার ঘোষ। নিজের ৬টি গাভি আছে। সেই গাভির দুধ বিক্রি করেই তার সংসার চলে। ৪০ টাকা দরে ১০ কেজি দুধ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে হাতে পেতেন ৪০০ টাকা। সেই একই দুধ এখন বিক্রি করে পান ৯০০ টাকা। কেমন করে এটা সম্ভব হলো জানতে কথা বলি পবিত্রের সঙ্গে। তিনি জানান, মিল্ক প্রসেসিং মেশিনের কথা। এটি তিনি পেয়েছেন স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে। ছোট্ট এই যন্ত্রে দুধ ঢেলে সহজেই ক্রিম আলাদা করা যায়, সেই ক্রিম জ্বাল দিয়ে হয় ঘি। পবিত্র এখন প্রতিদিন বাজারে দুধ বিক্রির আগে ঘি ক্রিম আলাদা করে নেন। ১০ কেজি দুধ থেকে ঘি হয় হাফ কেজি। বাজারে সেই হাফ কেজি ঘি বিক্রি হয় ৬০০ টাকা। ক্রিম আলাদা করা লো ফ্যাট ১০ কেজি দুধ বিক্রি হয় ৩০০ টাকায়। এভাবে ভ্যালু এড হয়ে পবিত্রেরও লাভের অঙ্ক বেড়ে যায়। পবিত্র এই দুধ বিক্রি করে নিজের মাটির ঘর পাকা করেছেন। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন।
বাছুর পালনে কাফপেন প্রযুক্তির ব্যবহার : পারিবারিক ডেইরি খামার করে ভালো ফলাফল পেতে কাফপেন ব্যবহারে উৎসাহিত করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের’ সহযোগিতায় পারিবারিক ডেইরি খামারে কাফপেন ব্যবহারের পদ্ধতিও শেখানো হয়। এ পদ্ধতি ব্যবহার করলে, বাছুরের মাটি খাওয়া বন্ধ হয়, ফলে ডায়ারিয়া হয় না। বাছুরের নাভিপচা রোগ হয় না। গাভির ওলান থেকে বাছুরের বেশি দুধ খাওয়া বন্ধ হয় ফলে বাছুরের বদহজমও হয় না।
গøাসফাইবার বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন ও ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন : পারিবারিক জ¦ালানি ও সারের চাহিদা পূরণে এটি একটি সফল পদ্ধতি। মাত্র ৬টি গরুর গোবর থেকে একটি বায়োপ্লান্ট করা সম্ভব। এটি আবার স্থানান্তরও করা যায়। একই সঙ্গে বায়োগ্যাসের ¯øারি কেঁচো দ্বারা পরিচর্যার মাধ্যমে উন্নতমানের কেঁচোসার বা ভার্মি কম্পোস্টও প্রস্তুত করা যায়। পদ্ধতিটিকে জনপ্রিয় করতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মীরা।
গবাদিপশু পালনে অনুকরণীয় সাফল্য : দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের এক অপার সম্ভাবনাময় অঞ্চল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বলতে এখানে খুলনা বিভাগকে ধরা হয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৪৩ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ অঞ্চলে রয়েছে ৫৯টি উপজেলা, একটি মেট্রো থানা ও ১০টি জেলা। গবাদিপশু ও পোলট্রির উৎপাদন বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, গৃহস্থ পর্যায়ে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ, পশুস্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং প্রাণিসম্পদ কেন্দ্রিক স¤প্রসারণ কর্মকাণ্ড জোরদারকরণের লক্ষ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সম্পূর্ণ জিওবির অর্থায়নে গ্রহণ করা হয় ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প। প্রকল্পের প্রধান অঙ্গগুলো হচ্ছে : (ক) প্রদর্শনী ও ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ প্রযুক্তির হস্তান্তর, (খ) প্রকল্প এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন, (গ) গবাদিপশু লালন-পালনকারী অর্থাৎ খামারি ও কমিউনিটি লাইভস্টক এক্সটেনশন ভলেন্টিয়ার প্রশিক্ষণ। প্রকল্পের আওতায় গবাদিপশুর জন্য ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন, ডিওয়ার্মিং ক্যাম্পেইন, গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ প্যাকেজ, ডেইরি ডেমোনেস্ট্রেশন প্যাকেজ, কাফপেন ডেমোনেস্ট্রেশন প্যাকেজ, লেয়ার মুরগি পালন প্যাকেজ, ব্যাকইয়ার্ড পোলট্রি পালন প্যাকেজ, ছাগল ডেমোনেস্ট্রেশন প্যাকেজ, খামারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্যাকেজ, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে দুধ সংগ্রহ প্যাকেজ, প্রাথমিকভাবে দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্যাকেজ, ফডার ডেমোনেস্ট্রেশন প্যাকেজ, ভেটেরিনারি মেডিকেল প্যাকেজের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ৪ হাজার ৩৩৬ জন খামারিকে গবাদিপশু লালনপালনে বিভিন্ন উপকরণ বিনা মূল্যে প্রকল্প থেকে দেয়া হয়েছে। যেমন মাচায় ছাগল পালনের জন্য ৩০০ জন ছাগল পালনকারীকে ছাগলের মাচাসহ ঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে, দানাদার খাদ্য দেয়া হয়েছে, প্রদান করা হয়েছে ভ্যাকসিন ও ওষুধ। এতে করে ছাগলের রোগব্যাধি কম হয়, ছাগলের ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ফলে মাচায় ছাগল পালন করে সংশ্লিষ্টরা অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত লাভবান হচ্ছেন।
গরু হৃষ্টপুষ্টকরণের লক্ষ্যে আগ্রহী ৩০০ জন খামারিকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট অনুপাতে পানিতে ইউরিয়া সার ও চিটাগুড় মিশিয়ে তা খড়ের ওপর ছিটিয়ে দিয়ে ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র (টগঝ) তৈরি করা হয়। এই ইউএমএসএ থাকে প্রচুর পরিমাণে নন প্রোটিন নাইট্রোজেন, যা খাওয়ানোর ফলে গরুর পাকস্থলীতে গিয়ে হজম হয়ে উক্ত নাইট্রোজেন কণামুক্ত প্রোটিন কণায় রূপান্তরিত হয়ে রক্তে মিশে এবং দ্রুত পশুর ওজন বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া ইউরিয়া মোলাসেস মিনারেল ব্লুক বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করেও একই পদ্ধতিতে গরু দ্রুত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। কোনো স্টেরয়েড বা হরমোন ব্যবহার ছাড়াই দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণের ফলে কুরবানির জন্য বিদেশ-নির্ভরতা এখন নেই বললেই চলে। মাংসের জন্য গরু ও ছাগল উৎপাদনে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, নড়াইল ও খুলনা জেলার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অগ্রগামী।