স্ত্রীর পরকীয়ার বলিই ঝিনাইদহ এলজিইডি’র গাড়ি চালক
#মোস্তফা কামাল, ঝিনাইদহের চোখঃ
ঝিনাইদহের এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর গাড়িচালক এটিএম হাসানুজ্জামান ওরফে জগলু হত্যার রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
নিহতের স্ত্রী তাহমিনা পারভীন তমা (৩৭) দুই প্রেমিকের সহযোগিতায় স্বামীকে হত্যা করেছেন বলে দাবি পিবিআই’র। শনিবার স্বামী হত্যায় স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দুই পরকীয়া প্রেমিকের সহায়তায় স্বামীকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। পরে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারক গৌতম মল্লিকের কাছে ১৬৪ ধারায় আসামি জবানবন্দি দিয়েছেন।
নিহত জগলু কুষ্টিয়া সদর উপজেলার জুগিয়া স্কুলপাড়া এলাকার মৃত জহুরুল আলমের ছেলে। গত ২৮ আগস্ট যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কের চুড়ামনকাঠি বারীনগরের মাঝামাঝি এলাকার মাঠে লাশ পাওয়া যায়।
রোববার সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, শনিবার জগলু হত্যা মামলার আসামি তার স্ত্রী তাহমিনা পারভীন তমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি হত্যার পরিকল্পনা ও মিশন বাস্তবায়নের কথা স্বীকার করেছেন। দাম্পত্য কলহ ও পরকীয়ার জেরে হত্যাকা- ঘটেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে এটিএম হাসানুজ্জামান ওরফে জগলুর সাথে আসামি তাহমিনা পারভীনের বিয়ে হয়। তাদের সংসার জীবনে দুই ছেলেমেয়ে আছে। স্বামী ২০০৮ সালে সাসপেন্ড হওয়ার পর সংসারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। এর জের ধরে তাদের মধ্যে পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়।
তখন থেকে তাদের দাম্পত্য জীবনে বিপর্যয় ঘটে। তাহমিনা ঢাকায় বসবাসকালে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। গত ২৬ আগস্ট মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনে তাহমিনা পারভীন তার ছেলের বাসায় যান। ওইদিন তাহমিনার সাথে তার স্বামীর মোবাইল ফোনে ঝগড়া হয়। হাসানুজ্জামান তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
সন্ধ্যার পর ছেলের বাসার সামনে রাস্তায় নেমে এসে বন্ধু আলামিন ও মুরসালিনকে মোবাইল ফোন করে আসতে বলেন। তারা দুজন আসার পর হত্যার পরিকল্পনা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আলামিন ও মুরসালিন মিরপুরের একটা ওষুধের দোকান থেকে পাতলা কাঁচের বোতলে চেতনানাশক ওষুধ এবং ফাঁস দেয়ার জন্য দড়ি সংগ্রহ করেন। এরপর একটা উবারের গাড়িতে ওঠেন।
গাড়িচালকের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া এলাকায়। তিনি তাহমিনা পারভীন ও তার বন্ধুদের পূর্বপরিচিত। বিভিন্ন সময় তাদের প্রয়োজনে তাকেই ডেকে নেন। এরপর তাহমিনা পারভীন মুরসালিনের মোটরসাইকেলে ও আলামিন উবারের গাড়িতে কেরানীগঞ্জের বাসায় চলে যান। ২৭ আগস্ট ভোর আনুমানিক ৫টার দিকে পাটুরিয়া ঘাট পার হয়ে ঝিনাইদহ হয়ে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তাহমিনাসহ তার বন্ধুরা যশোরে পৌঁছান। ১২টার দিকে গাড়ি নিয়ে যশোর ‘জাবির ইন্টারন্যাশনাল’ হোটেলে যান। তাহমিনা পারভীন আলামিন ও মুরসালিনের পরিচিত যশোরের একজনকেও হোটেলে দেখতে পান। তারা সবাই লিফ্টে দোতলার রেস্টুরেন্টে যান। সেখানে তাহমিনা পারভীন ওয়াশরুমে ফ্রেশ হন। রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া শেষে স্থানীয় ব্যক্তির বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেন। এরপর তারা গাড়ি নিয়ে উবারের গাড়ির ড্রাইভারের বাড়িতে যান। এসময় স্বামী জগলু তাহমিনা পারভীনকে ফোন দিলে তিনি তাকে বলেন থ্রি-পিচ ও কসমেটিকস মালামাল কেনার জন্য যশোর এসেছেন। তখন স্বামী জগলু স্ত্রীর কাছে ৫০ হাজার টাকা চাইলে, তাহমিনা ২০ হাজার টাকা দেয়ার কথা বলেন। এসময় স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে জগলু ঝিনাইদহ শামীমা ক্লিনিকের সামনে টাকা নেয়ার কথা জানান। তাহমিনা ও তার বন্ধুরা যশোরে ঘোরাফেরা করে সময় কাটান। সন্ধ্যার পর ঝিনাইদহের উদ্দেশ্যে গাড়ি নিয়ে রওনা হন। রাত ১০টার দিকে শামীমা ক্লিনিকের সামনে পৌঁছে তাহমিনা তার স্বামীকে গাড়িতে উঠিয়ে নেন।
জগলু পিছনের ছিটের মাঝখানে, তাহমিনা স্বামীর বামে এবং আলামিন ডানে বসেন। মুরসালিন গাড়ির সামনের ছিটে বসেন। ঝিনাইদহ শহর পার হয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাহমিনা পারভীন ও আলামিন দুইদিক থেকে ভিকটিমের দুই হাত ধরেন। আলামিন তুলা ভিজিয়ে চেতনানাশক ওষুধ জগলুর নাকে চেপে ধরলে তিনি অচেতন হয়ে যান। তখন আলামিন, মুরসালিন ও তাহমিনা পারভীন রশি দিয়ে জগলুর গলা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। ড্রাইভার গাড়ি যশোরের দিকে চালাতে থাকেন। প্রায় ৪০ মিনিট পথ যাওয়ার পর একটা ফাঁকা জায়গায় রাস্তার ডানদিকে গাড়ি থামিয়ে আলামিন ও মুরসালিন জগলুর মৃতদেহ গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে রাস্তার ডানপাশে ঢালে ফেলে দেন। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য আলামিন ও মুরসালিন ভিকটিমের গলায় ছুরি দিয়ে জবাই করেন। তাহমিনা পারভীন গাড়িতে বসেছিলেন। এরপর আলামিন ও মুরসালিন তাড়াহুড়া করে গাড়িতে উঠেন এবং ঢাকার দিকে রওনা দেন। ঢাকা যাওয়ার পথে মুন্সিগঞ্জে মুরসালিনের খালার বাসায় উঠেন। সেখানে ড্রাইভার, আলামিন ও মুরসালিন গাড়ি ধুয়ে ফেলেন। তাহমিনা পারভীনের পরনে থাকা পোশাক ওই বাসায় খুলে অন্য কাপড় পরে সকলে ঢাকা চলে যান।